চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ৮৯ শতাংশ রোগী আগে থেকে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের অক্সিজেনের মাত্রা, রক্তের শ্বেতকণিকা, সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (সিআরপি), ফেরিটিন এবং ডি-ডাইমারের মাত্রা ছিল মারাত্মক কম বা বেশি। এই উপাদানগুলোর বড় রকমের হেরফেরের কারণে আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার পরও তাদের বাঁচানো যায়নি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের রক্তের বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে ‘মৃত্যু ঝুঁকির সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ’ শীর্ষক এক যৌথ সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যদিও এটিকে তারা গবেষণা প্রতিবেদন বলে দাবি করেছেন। সিভাসু উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ইসমাইল খানের নেতৃত্বে এ যৌথ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে দুই উপাচার্য ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবীর, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি, সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়াসহ গবেষণায় অংশ নেওয়া চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন। চলতি বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে করোনায় আক্রান্ত ২৩৪ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত রক্তের বিভিন্ন উপাদানের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা।
সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ইসমাইল খান বলেন, আক্রান্ত রোগী যারা আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন, তাদের বিভিন্ন প্যারামিটার তখন কেমন ছিল, তা পর্যালোচনা করাই ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। দেখা গেছে, বেশির ভাগের হিমোগ্লোবিন ও অঙিজেন মাত্রাতিরিক্ত কমে গিয়েছিল। আর ট্রপোনিন, ডি-ডাইমার, সিআরপি অনেক বেশি পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে তার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।
সিভাসু উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, কোভিডকালীন সিভাসু, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জেনারেল হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এই ধরনের গবেষণা কাজগুলো চিকিৎকদের একটা দিকনির্দেশনা দেবে। ওমিক্রন শনাক্তে সিভাসু দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইতিমধ্যে ১০০ কিট এনেছে বলেও উপাচার্য জানান।
গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, আইসিইউতে ভর্তি হওয়া ২৩৪ জন রোগীর মধ্যে ১৫৬ জন মৃত্যুবরণ করেন। সুস্থ হয়ে ফিরে যান ৭৮ জন। মারা যাওয়া ৭৩ শতাংশ রোগীর বয়স পঞ্চাশের বেশি। তাদের মধ্যে ১৩৯ জন অর্থাৎ ৮৯ দশমিক ১ শতাংশ রোগী বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতায় আগে থেকেই ভুগছিলেন। আবার এদের মধ্যে ৯৩ রোগীর একাধিক স্বাস্থ্য জটিলতা ছিল, যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানির মত সমস্যা।
সমীক্ষায় দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ রোগীর রক্তে সিআরপির পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিক মাত্রা লিটারে ৫ মিলিগ্রামের কম। কিন্তু সিআরপি প্রতি লিটারে গড়ে ১০২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মৃত্যুবরণকারী ৭৩ শতাংশ রোগীর রক্তে অঙিজেনের চাপ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে গড়ে ৫০ দশমিক ৪ মিলিমিটার কম। স্বাভাবিক মাত্রা ৭০ থেকে ৯০ মিলিমিটার। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম, যার গড় পরিমাণ ১০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা ১২ থেকে ১৭ গ্রাম/ডেসিলিটার। মৃত্যু হওয়া ৭৫ রোগীর রক্তের শ্বেতকণিকার মান ২৬ হাজার ১১০ ঘন মিলিমিটারের বেশি পাওয়া গেছে। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৪ হাজার থেকে ১১ হাজার ঘন মিলিমিটার। আবার ৭৬ শতাংশ রোগীর রক্তে ট্রপোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, শূন্য দশমিক ৮১ ন্যানোগ্রাম পর্যন্ত ছিল। এর স্বাভাবিক মাত্রা শূন্য দশমিক ৪ ন্যানোগ্রাম।
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ, জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট রাজদ্বীপ বিশ্বাস, জুনিয়র কনসালট্যান্ট মৌমিতা দাশ, সিভাসুর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ত্রিদীপ দাশ, সিভাসুর মলিকিউলার বায়োলজিস্ট প্রণেশ দত্ত, সিরাজুল ইসলাম ও তানভির আহমেদ নিজামী প্রমুখ এ গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।












