বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সে সাথে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস হতে শুরু হয় এদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হত্যাকাণ্ডের নীলনক্সা। বাঙালি হারায় তাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এদিন বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ঘাতকের বুলেট বিদ্ধ করে কালজয়ী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে-সপরিবারে। বিদ্ধ হয় গোটা বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশ। রচিত হয় পৃথিবীর এ যাবতকালের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্যতম ইতিহাস।
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট নরপিশাচ খুনিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ১৯৭৫ সালের পনের আগস্টের কালরাত্রিতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জেলখানার অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মাত্র চারদিন পরই ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকাণ্ড। তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের এদিন থেকে শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের নামে প্রথমে হত্যা করা হয় তিন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে। এরা হলেন, খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কে এন হুদা বীর উত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীর বিক্রম। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দু’জন কোম্পানি কমাণ্ডার আসাদ এবং জলিল। সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস এ ব্যাপারে তার গ্রন্থে লিখেছেন ‘এ ছাড়াও এদিন উচ্ছৃংখল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়।’ ৭ নভেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এই দিনটিকে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস হিসাবে পালন করে। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন সিপাহী বিপ্লবের নামে এদিন থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যা প্রক্রিয়া। এর আগে ৬ নভেম্বর ভোর রাতে গৃহবন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় যার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল সেই ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিল এই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর অ্যার্টিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে।
গোলাম মুরশিদ তাঁর গ্রন্থে (মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর) ‘মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে (বিচারপতি আবু সাদত সায়েম) কথা না বলেই বেতারে ভাষণ দিতে চলে যান। ’৭১-এর ২৭ মার্চের মতোই সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ তিনি প্রথমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। পরে শুধরে নিয়েছিলেন। এবারও তিনি নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ঘোষণা করেন। পরে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন।’
পরবর্তীতে একে একে গণভোট, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেও তার আমলে ২০টির বেশি অভ্যুথান হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়। এক হিসাবে প্রায় প্রতি তিন মাসে একটি করে অভ্যুথানের চেষ্টা হয়েছিল জিয়ার শাসন আমলে। জিয়ার আমলে একটার পর একটা অভ্যুথান সেনাবাহিনীতে হতেই থাকে। প্রতিটি অভ্যুথানের পর বহু সেনা সদস্যকে তিনি ফাঁসিতে ঝোলান। অনেককে বিনা বিচারেও পাইকারিভাবে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়েছিল জনশ্রুতি আছে। বিশেষ করে ৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমান বাহিনীর অভ্যুথানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারে অথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বিমান বাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা থাকেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতে পারতেন মাত্র তিনজন। মার্কাস ফ্র্যান্ডার মতে এই অভ্যুথানের কারণে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়। ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা দেশকে চুড়ান্তভাবে সে জায়গায়ই নিয়ে যেতে থাকে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী অস্থিতিশীল সময়ে ৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কুশীলব জেনারেল জিয়া তথাকথিত সিপাহি জনতার বিপ্লবের নামে এক কুৎসিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যার ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়ন করেছিলেন। যা জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সর্বশেষ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক পূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর মঞ্জুরসহ ১১ জন সামরিক কর্মকর্তা যাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো সাত্তার সরকার প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দিয়ে ও গুলি করে তাদের হত্যা করে। ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে বিএনপি, যা জাতির সঙ্গে একটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেদিন আসলে কোনো বিপ্লব হয়নি, আর জনগণের সংহতির তো প্রশ্নই নেই। ৭ নভেম্বর বিএনপির জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন ও ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন রহস্য ঢাকা একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বিএনপি মূলত, এই দুটি দিবসে বিজয় উল্লাস করে থাকে। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বিএনপি ও স্বাধীনতার পরাজিত কিছু সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী যারা জিয়াউর রহমানের কল্যাণে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে এমন কয়েকটি ক্ষুদ্র দল শুধু দিনটি পালন করে থাকে।
বিএনপি ৭ নভেম্বরের ঘটনায় জিয়াউর রহমানকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও ইতিহাসের স্বীকার্য সত্য মূলত তিনি ছিলেন বিশ্বাসঘাতক এবং একজন খলনায়ক। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত বাংলাদেশের চরিত্রটাই বদলে দেয়। এই অভ্যুত্থানের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় দীর্ঘ অবৈধ সেনা শাসনের ভিত রচিত হয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের পর্ব। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি! নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, অবৈধ উপায়ে একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন, গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হ্যাঁ-না ভোট করা, সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তুলে দেয়া, রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে নিজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উগ্র সামপ্রদায়িক রাজনীতি চর্চার সুযোগ দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু, তথাকথিত ক্যুর অভিযোগে শত শত সেনাকর্মকর্তা হত্যা ও হাজার হাজার সেনা সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়।
খুনিদের নিরাপত্তা দিয়ে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, জেলহত্যা বিচারের তদন্ত স্থগিত করা, বিনা কারণে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে ঢুকিয়ে দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া, যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানের ও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। শাহ আজিজের মতো যুদ্ধাপরাধীকে প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াসহ এমন সব অপকর্ম করেছেন যাতে বাংলাদেশ কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও আদর্শের পরিপন্থি।
৭ নভেম্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই ঘটনায় লাভবান হয়েছে শুধু জিয়াউর রহমান ও উগ্রবাদী সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী। আর পরাজিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত অহংকারকে পদদলিত করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিপ্লব ও সংহতির নামে একটি মিথ্যা আজগুবি তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানুষ এখন সঠিক তথ্য পাচ্ছে বলে মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে না। বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমানকে যতই নায়ক বানানোর চেষ্টা করা হোক না কেন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী খলনায়ক হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে।
লেখক: সহ-সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমাণ্ড, কেন্দ্রীয় কমিটি।