৭ নভেম্বর এবং মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড

রোকন উদ্দীন আহমদ | মঙ্গলবার , ৭ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দিনটির ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্রিয়ভাবে। দিনটিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলবিএনপি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলজাসদ ‘সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে। ভিন্ন ভিন্ন নামকরণে ও চেতনায় দিনটি পালন করা হলেও কোনটি যথার্থতা নির্ণয়ে জানতে হবে কী ঘটেছিল সেদিন? জাতির জানা প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস।

৭ নভেম্বরের ঘটনা বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিকভাবে আরো কয়েকটি ঘটনা সামনে আসবে। কারণ ৭ নভেম্বরের ঘটনা ইতিহাসের বিচ্ছিন্ন নয়। কয়েকটি ঘটনার পরবর্তী ঘটনা। ৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীতে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানপাল্টা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল রক্তাক্ত ৭ নভেম্বর। সেদিনের ঘটনাবলীর মধ্যে প্রধান ঘটনা হচ্ছে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম সহ ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যা। ৭ নভেম্বরের হত্যার ঘটনা ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড ও ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে একসূত্রে গাঁথা। তাই ৭ নভেম্বর ঘটনার পূর্বের ঘটনাগুলো আলোচনায় আনতে হবে।

১৫ আগস্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে জড়িত খোন্দকার মোসতাক আহমদকে খুনিরা রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। খুনিদের সরকার টিকে থাকতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। চারনেতার বাইরে বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। আবদুস সামাদ আজাদকে ২০ বছরের জেল দেওয়া হয়। ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৩ নভেম্বর জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জাতীয় চারনেতাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর কতিপয় ষড়যন্ত্রী সদস্য। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার ২১ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক কালের কণ্ঠে তাঁর কলামে লিখেছেন, ‘বঙ্গভবন থেকে হত্যার অনুমতি দেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসা খোন্দকার মোসতাক।’ ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান মোসতাক সরকারের সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে নীরবতাকে তার সম্মতি বলে ধরে নেয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সরকার উৎখাতে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান হয়। অভ্যুত্থানে সেদিন প্রত্যুষে সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। জিয়াউর রহমানের বন্দি থাকা এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনী প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজরদের পরিবেষ্টিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোসতাককে অপসারণ করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়। বন্দি থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমান টেলিফোনে কর্নেল আবু তাহেরকে তাঁর জীবন বাঁচানোর অনুরোধ করেন। জিয়াউর রহমানকে রক্ষায় এগিয়ে আসে কর্ণেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে জাসদের গোপন সংগঠন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। এসময় পুরো ঢাকা সেনানিবাস জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলা হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিটি ব্যরাকে হাজার হাজার লিফলেট বিলি করা হয়। লিফলেটের বক্তব্য ছিল, খালেদ মোশাররফ ভারতের দালাল, ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী শিগগিরই ঢাকায় চলে আসছে। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পাল্টা অভ্যুত্থান করতে কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সেনাবাহিনীর অমুক্তিযোদ্ধা জেসিওএনসিওদের গ্রুপ তৎপর হয়। এর সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যার দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরাও সক্রিয় হয়। এমন পরিস্থিতির কয়েকদিনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ৭ নভেম্বর কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য জিয়াকে মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর খুনি সেনা কর্মকর্তাদের গ্রুপও যুক্ত হয়। মুক্ত করে জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হত্যায় অংশগ্রহণকারী ২ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। রেজিমেন্টটির কমান্ডিং অফিসার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর মহিউদ্দিন। জেনারেল জিয়া মুক্ত হয়ে মেজর মহিউদ্দিনের রেজিমেন্ট দপ্তরে থাকা অবস্থায় পাকিস্তান ফেরত বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত সেনাবাহিনীর অমুক্তিযোদ্ধা জেসিওএনসিওদের পরিবেষ্টিত ছিলেন। সেসময় তাদের সাথে আঁতাত করেছিলেন। কর্ণেল আবু তাহের সকাল সাড়ে ৬টার দিকে জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করেন। কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম। জিয়াউর রহমানের সাথে থাকা দুজন অফিসার কর্ণেল আবু তাহেরকে ভর্ৎসনা করেন। জিয়াউর রহমানের সামনেই তারা তাকে ভারতের দালাল আখ্যায়িত করে তিরস্কার করেন। সেনাবাহিনীর এই অংশটি পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই মদদপুষ্ট থাকার তথ্য বর্তমানে প্রকাশ পাচ্ছে। কর্ণেল আবু তাহের বুঝতে পারেন জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এভাবে কর্ণেল আবু তাহের ও জাসদের কথিত অভ্যুত্থান বিফল হয়। পরে সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ দিয়ে ৭৬ সালের ২১ জুলাই প্রাণরক্ষাকারী কর্ণেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেন জিয়াউর রহমান। সামরিক আদালতে জিয়াউর রহমানকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করেছিলেন কর্ণেল আবু তাহের।

পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল খালেদ মোশাররফের প্রতিকুলে চলে যায়। তিনি তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে সঙ্গীসহ শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। রেজিমেন্টটির কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্ণেল নাওয়াজিস। তিনি খালেদ মোশাররফকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে জেনারেল খালেদ মোশাররফের জ্যেষ্ঠ কন্যা মাহজাবিন খালেদের বক্তব্য, ‘কর্ণেল নাওয়াজিস ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে জেনারেল খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির খবর টেলিফোনে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জানান। ভোরবেলা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। এই উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর আসাদ ও মেজর জলিল। মেজর আসাদ ও মেজর জলিল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরই জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমসহ আশ্রয় নেওয়া সেনা কর্মকর্তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেন।’ উল্লেখ্য সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারসেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম, সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এটিএম হায়দার বীরোত্তম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সাব সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল নাজমুল হুদা বীরবিক্রমসহ ১০ থেকে ১৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। ৭৫ এর রক্তাক্ত ঘটনার ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বরের এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলিক চরিত্রকেই বদলে দেওয়া হয়। কথিত এই অভ্যুত্থানের ফলে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। স্বাধীনতা বিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ী অপশক্তির উত্থান দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে নিয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় কালিমালিপ্ত দিনটিকে বিএনপি ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বলে থাকে। কিন্তু বিপ্লবের নেতা কে? তার নাম বলে না। ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে কারা সংহতি জানিয়েছিল? বিপ্লব রাতের আঁধারে হয়েছিল কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই বিএনপির? কথিত বিপ্লবটির সিদ্ধান্ত কারা, কোথায়, কখন নিয়েছিল? বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনের সময় বিএনপি এ কথা বলে না। স্বাভাবিকভাবে বিপ্লব রাজনৈতিক অঙ্গনের শব্দ। ক্যান্টনমেন্টের শব্দ হচ্ছে বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান। কাজেই ৭ নভেম্বরের ঘটনা বিপ্লব ছিল না, ছিল পাল্টা অভ্যুত্থান। কেননা মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড বিপ্লব হতে পারে না। জাসদ দিনটিকে সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবস বলে থাকে। পাল্টা অভ্যুত্থানে জাসদের গোপন সংগঠন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র সদস্য ছাড়া সাধারণ সিপাহীদের অংশগ্রহণ ছিল কিনা? রাজপথে মিছিলকারীদের মধ্যে জাসদের গণবাহিনীর সদস্য ছাড়া সাধারণ জনতা ছিল কিনা? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেদিন কোনো সাধারণ জনতা জাসদের পাল্টা অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল না। অভ্যুত্থানটিতে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যা এবং অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজাকার শাহ আজিজের দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা নিন্দনীয়। তাই কথিত সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়েছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রণেশ মৈত্র ২১ সালের ৭ নভেম্বর তাঁর এক লেখায় দিনটিকে ‘তথাকথিত বিপ্লবের দিন’ আখ্যায়িত করেছেন। জাসদের কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাস বলে উল্লেখ করেছেন। কাজেই ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ বা ‘সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ কোনটিই সচেতন মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত ৭ নভেম্বরের কথিত বিপ্লব, অভ্যুত্থান হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বীজ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমীর ইশাদ তাসফীন
পরবর্তী নিবন্ধনদীর নাম কর্ণফুলী : যাকে ঘিরে দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি