৭ই মার্চ : ইতিহাসের সেই বজ্রকণ্ঠ

পিংকু দাশ | বুধবার , ৬ মার্চ, ২০২৪ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

মিছিল থেকে ছড়িয়ে পড়ে বজ্র কণ্ঠস্বর

রেসকোর্সের মাঠ হয়েছে বঙ্গোপসাগর।

বাংলার সব নদী এসে মিললো আপন মনে

এদিক ওদিক মুখর হলো গর্জনে গর্জনে।’

রাশেদ রউফ (আমার সোনার বাংলা)

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে এনে বাঙালি জাতিকে পূর্ণতা এনে দিয়েছেন যে মহানায়ক, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি।

১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক মুসলিম পরিবারের শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতার এই মহানায়ক। টুঙ্গিপাড়া আলোকিত করা এই খোকা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির মুজিব ভাই এবং বঙ্গবন্ধু। তাঁর হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা শুধু বাঙালির না, বিশ্বের অবহেলিত, নিপীড়িত জনতার বন্ধু। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সবসময় নিপীড়িত, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসতেন। তিনি যখন মিশনারী স্কুলের ছাত্র তখন স্কুল পরিদর্শনে আসেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ শোহরাওয়ার্দী। স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা ও ছাত্রাবাস নির্মাণের দাবি উত্থাপন করে মুজিব ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এজন্য তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছিল। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিদারুণ বঞ্চনা, শিক্ষিত এবং রাজনীতিসচেতন বাঙালিরা যখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন, তখন বাঙালির বঙ্গবন্ধু স্বাধীনসার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য গোপনে কাজ করতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দীন উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালি ছাত্র যুবসমাজ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট চলাকালীন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। জেলে থেকেই বঙ্গবন্ধু গোপনে ভাষা আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এর প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বপন করা হয়। সার্বিকভাবে ছয় দফা পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা, বাঙালির প্রথম মুক্তির সনদ। ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তিলাভের পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে এক গণসংবর্ধনার আয়োজন করেন। গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই বিজয়কে মেনে নেয়নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন। ফলে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দেন

প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

জাতিসংঘের ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এই ঐতিহাসিক ভাষণ। তার সঙ্গে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টারে (এমওডব্লিও) এ ভাষণটি সসম্মানে সংগৃহীত হয়েছে। এই ভাষণ মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। যা প্রকারান্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকে পড়তে উৎসাহিত করে, বাঙালি জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথের সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছিল।

রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পৃঃ২৯৮) থেকে জানা যায়, একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপরদিকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুলকলেজ, গাড়ি, শিল্পকারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ই মার্চ থেকে ২৫ই মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।

১৯৭১ এর ৭ থেকে ২৫ই মার্চ এ ১৮ দিনে এ ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়ামুজিবভুট্রো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:

এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের, জনগণ তোমরা যে যেখানে আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম , কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাত ১.৩০ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘স্বাধীনতা’ যা একদিনে অর্জিত হয়নি। অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট, হাজার হাজার মাবোনের ইজ্জত এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণ এর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পূর্বের ধর্মান্ধতা, সামপ্রদায়িকতা, শোষণ, বঞ্চণা, অত্যাচার, নিপীড়ন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালিরা দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছে। ৭ই মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র একটি ভাষণ নয়, এটি একটি মহাকাব্য, যা বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। একটি মুক্তির বাণী, যা শোনার জন্য দলে দলে লোক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিল।

৭ই মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা, ৭ কোটি মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং মানসিক প্রস্তুতির রূপরেখা। এই ভাষণে ছিল বাঙালির বঞ্চনা, লাঞ্ছনার করুণাত্মক ইতিহাস, নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস, ছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও। গ্রামেমহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার কথা, তিনি যদি নাও থাকতে পারেন বা হুকুম দেবার সুযোগ না পান বাঙালিরা যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায় সেই নির্দেশনাও ছিল। আর ছিল স্বাধীনতা এবং মুক্তিসংগ্রামের কথা। এ কালজয়ী ভাষণ প্রদানের পর নিউইয়র্কের দ্য নিউজ উইক ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিঙ’ বা রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করে। সবশেষে ‘জয় বাংলা’ বলে যে ভাষণটি শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধু তা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল।

লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে দুই কেজি ক্রিস্টাল মেথসহ আটক ৩