লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের বৃত্তিপ্রাপ্ত অদম্য মেধাবী অথচ কষ্টে থাকা শিক্ষার্থীরা বলেছেন, এটা শুধু একটি বৃত্তিই নয়, এটি আমাদের স্বপ্ন পথের সিঁড়ি। এই বৃত্তির টাকা যে কিভাবে আমাদেরকে একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছে সেটি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন বললেন, বৃত্তির এই টাকাটা না হলে আমার পরীক্ষা দেয়া হতো কিনা তাও জানি না। অথচ এখন আমি পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করার স্বপ্ন দেখছি। এই যে স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাচ্ছি এটা শুধুমাত্র লায়নিজমের সেবার কারণেই সম্ভব হয়েছে।
গরীব এবং অসহায় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার পথ সুগম করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্ট। এটি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যশনাল ডিস্ট্রিক–৩১৫বি৪ এর একটি স্থায়ী প্রকল্প। ২০১৮ সাল থেকে এই ট্রাস্টের বৃত্তি নিয়ে অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু মেধাবী সন্তান শিক্ষা অর্জনে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল শনিবার এই বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠানে জীবনে নানা চড়াই উতরাই পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসা মানুষগুলো নিজেদের জীবনের গল্প বলছিলেন। নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তারা শোনাচ্ছিল পাজর ভাঙা নানা শব্দমালা। জাকির হোসেন রোডস্থ লায়ন্স ফাউন্ডেশনের হালিমা রোকেয়া হলে গতকাল শনিবার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় এবারকার বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান। এবার মোট ৬৭ জন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে চলতি বছর নতুন বৃত্তিপ্রাপ্ত ২৫ জন, বাকি ৪২ জন আগের বৃত্তির ধারাবাহিকতায় বৃত্তি পেয়েছেন। প্রতিজন শিক্ষার্থীকে মাসিক ২ হাজার টাকা করে মোট ২৪ হাজার টাকা এককালীন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। লায়ন মোস্তাক হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন লায়ন্সের ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর কোহিনুর কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে সাবেক গভর্নর লায়ন এম এ মালেক, লায়ন নাজমুল হক চৌধুরী, প্রথম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোসলেহ উদ্দীন অপু বক্তব্য রাখেন। লায়ন মোহাম্মদ হাসান মাহমুদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের সেক্রেটারি লায়ন এ এইচ এম কফিল উদ্দীন, লায়ন ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, লায়ন জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী, লায়ন হাসান আকবর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল বৃত্তি পাওয়া ৬৭ জন তুমুল মেধাবী ছাত্রছাত্রী নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, লায়ন সদস্যরা যেভাবে ভালোবাসা দিলেন, সেভাবে সবাই এগিয়ে আসলে তার এবং তার মতো অনেকের জীবনের গল্প পাল্টে যেতো। রিকশাওয়ালা, বাসের কন্ট্রাক্টর কিংবা দিনমজুর হওয়ার অবস্থা থেকে তারাও জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখতো। লায়ন্স ক্লাবের এই বৃত্তি ভবিষ্যতেও বহু অসহায় ছাত্রছাত্রীকে পথ দেখাবে, আলো দেখাবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে। তারা নিজেরাও একদিন অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
বৃত্তি পাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দৃষ্টিহীন ছাত্র মোহাম্মদ মিজান বলেন, ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় মাকে হারাই, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাবাকে। চোখও নেই। তবুও কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমার যে কী কষ্ট তার অনেক কিছুই হয়তো অন্যরা বুঝবে না। লায়ন্সের এই বৃত্তির টাকা আমার সেই কষ্ট অনেকটা ঘুচিয়ে দেবে।
নিজের এলাকা থেকে প্রথম কোনো শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে আসতে পারার কথা উল্লেখ করে খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত অঞ্চলের শানু আকতার নদী বলেন, আমি আমার এলাকার আমার মতো আরো অনেককেই পথ দেখাতে চাই।
নিজেদের অভাব অনটনের মাঝেও পরিবারের চাপ ছিল লেখাপড়া না করার। অথচ নিজেই টিউশনি করে নিজের খরচ যোগাড় করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ইনফরমেশনে পড়ছেন তিনি। তিনি বলেন, আমি আরো অনেককেই পথ দেখাতে চাই। আমার এই পথ দেখানোর চেষ্টা লায়ন্সের বৃত্তি অনেকটা সহজ করে দিয়েছে।
নানা জনের নানা গল্প। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ মেডিকেলে, কেউবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা। তবে সকলেরই মিল রয়েছে এক জায়গায়। তারা প্রত্যেকেই গরীব, অসহায়। তবে সবাই অদম্য মেধাবী। শৈশব–কৈশোরের সোনাঝরা দিনগুলো এদের কারোরই রঙিন ছিল না, নেই এখনো। লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের বৃত্তির টাকা এদের সামনে এগুনোর অনেক বড় অবলম্বন।
প্রসঙ্গত, লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫–২০১৬ সালে। লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর লায়ন মোস্তাক হোসাইন কল দেন ‘এডুকেশন ফর এঙিলেন্স’। কিছুদিনের মধ্যে তিনি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক ৩১৫বি৪ এর একটি স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করেন। লায়ন সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহীত ৪৩ লাখ টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখে তিনি লায়ন স্কলারশিপ ট্রাস্ট গঠন করেন। ব্যাংকে জমাকৃত এফডিআর–এর মুনাফা দিয়ে প্রতিবছর মেধাবী অথচ গরীব ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় ডোনার মেম্বার এবং লাইফ মেম্বার করে আরো ফান্ড সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে এই ফান্ডে ১ কোটি ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এফডিআর করা হয়েছে। এই এফডিআর থেকে প্রাপ্ত টাকার পাশাপাশি বিভিন্ন লায়ন্স ক্লাবের পক্ষ থেকেও ছাত্রছাত্রীদের স্পন্সর করা হয়।