দীর্ঘ ৫ বছর পর আলোর মুখ দেখছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) কাস্টডি ট্রান্সফার ফ্লো মিটার প্রকল্পটি। ২০১৬ সালে নেওয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালে টেন্ডার পর্যায়ে আসে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জমা পড়লে স্থগিত করা হয় প্রি-টেন্ডার মিটিং। এরপর তদন্ত কমিটি গঠনসহ বাতিল করা হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। গত ৭ জানুয়ারি নতুন করে আবার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। আগামীকাল ২ মার্চ দরপত্র উন্মুক্ত খোলার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইআরএল থেকে সরবরাহকৃত জ্বালানি পরিমাপে স্বচ্ছতা আসবে, সিস্টেম লস কমে যাবে, কমবে আর্থিক ক্ষতিও। বিপিসির একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘কাস্টডি ট্রান্সফার ফ্লো মিটার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, লেটেস্ট সেইট অব আর্ট অব কন্ট্রোল টেকনোলজি সংযোজন হবে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ডায়নামিক পরিমাপ পদ্ধতির পাশাপাশি প্রকল্পটিতে অটোমেটিক সেমপ্লিং (নমুনা সংগ্রহ) সিস্টেম থাকছে। এর ফলে ইআরএলে উৎপাদিত প্রোডাক্টগুলো পাম্পিং করার সময় অনলাইনে কোয়ালিটি জানা যাবে। এতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া ইআরএলে সিস্টেম লস কমে আসবে, এতে সরকার লাভবান হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ‘সেফটি ইনটিগ্রেটেড লেভেল থ্রি’ মানের কন্ট্রোল টেকনোলজি স্থাপিত হবে। ইআরএল প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছর পর এটাই প্রথম অত্যাধুনিক টেকনোলজি ইআরএলে স্থাপন হতে যাচ্ছে।’
সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব মালিকানাধীন পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) শতভাগ নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ইআরএল। ১৯৬৬ সালে নগরীর পতেঙ্গা গুপ্তখাল এলাকায় ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের টেকনিপ প্লান্টটি নির্মাণ করে। ইউনিটটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এই রিফাইনারি থেকে দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার ২৫ শতাংশ পূরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ম্যানুয়াল গেজিং পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়। মূলত ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত জ্বালানি পণ্য পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) মাধ্যমে সারাদেশে বিপণন করে বিপিসি। এসব জ্বালানি যে প্রক্রিয়ায় বিপণন কোম্পানিগুলোতে সরবরাহ দেওয়া হয়, তাকে কাস্টডি ট্রান্সফার বলে। ম্যানুয়াল হস্তচালিত গেজিং পদ্ধতিতে কাস্টডি ট্রান্সফারের কারণে তেল চুরির সম্ভাবনা থাকে। ২০১৬ সাল থেকে কাস্টডি ট্রান্সফার পদ্ধতিতে কম্পিউটারাইজড করার পদক্ষেপ নেয় ইআরএল। ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ১৬ মার্চ ‘ডিজাইন, সাপ্লাই, ইন্সটলেশন টেস্টিং এন্ড কমিশনিং অব কাস্টডি ট্রান্সফার ফ্লো-মিটার সুপারভিজরি কন্ট্রোল অ্যাট ইআরএল ট্যাংক ফার্ম’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তবে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রকল্পটি কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।
এদিকে বিগত ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু পত্রিকায় দরপত্র প্রকাশের পর নতুন করে জটিলতার তৈরি হয় প্রকল্পে। ঘোষিত দরপত্র উন্মুক্ত করার তারিখ দেওয়া হয় ৯ অক্টোবর। প্রি-টেন্ডার মিটিং দেওয়া হয় ২৬ সেপ্টেম্বর শনিবার। প্রি-টেন্ডার মিটিংয়ের আগেই ২৩ সেপ্টেম্বর বিষয়টি নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে মন্ত্রণালয়ে। এরপর স্থগিত করা হয় প্রি-টেন্ডার মিটিং। ৫ অক্টোবর বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। এরপর বাতিল করা হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। পরবর্তীতে গত ৭ জানুয়ারি নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। আগামীকাল ২ মার্চ দরপত্র উন্মুক্ত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। ইতোমধ্যে অনিয়মের অভিযোগে প্রকল্প পরিচালককে শোকজও করেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও ইআরএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (এসসিপি) জামিল আল মামুন এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমান প্রকল্প পরিচালক প্রথম দফায় দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে কিছু ভুল করেছিলেন। বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনে দরপত্র উন্মুক্ত করার সময় দিয়েছিলেন। যে কারণে প্রথম দফার দরপত্র বাতিল করা হয়। তবে এসব ভুলগুলো ইচ্ছাকৃত ছিল না, মূলত পুরোনো ক্যালেন্ডার দেখে তারিখ বসানোর কারণে এই ভুলটি হয়েছিল। তারপরেও একজন দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মকর্তার এ ধরণের ভুল কাম্য নয়। যে কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নতুন পিডি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে প্রথম থেকেই জটিলতা ছিল। কারণ একটি পক্ষ চায় না, তেল পরিমাপ পদ্ধতি অটোমেশন হউক। কারণ এখন সিস্টেম লসের নামে তেল চুরি হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তেল পরিমাপ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে তেল পরিমাপ করা হবে, তেল চুরিও বন্ধ হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘পুরো প্রকল্পটি ইলেক্ট্রিক্যাল। কিন্তু এখন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকল্প পরিচালক করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে প্রকল্প কাজের গুণগতমান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হবে, নতুন জটিলতা তৈরি হবে। মানে প্রকল্প বাস্তবায়ন যতই বিলম্বিত হবে, সুবিধাভোগীরা ততই লাভবান হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান শনিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রকল্প পরিচালককে শোকজ করা হয়েছে। তাছাড়া নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির মধ্য হতেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হবে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রকল্পটির সংশোধিত দরপত্র ডাকা হয়েছে। আগামী ২ মার্চ দরপত্র খোলা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সরবরাহকৃত তেল পরিমাপে জটিলতা অনেকাংশে কমে যাবে। এতে সিস্টেম লস কমে যাওয়ার কারণে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিও কমে আসবে।’