৫ জেটিতে স্ক্র্যাপসহ ভারী পণ্যবাহী জাহাজের বার্থিং এক মাস বন্ধ

ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় সংস্কার কাজ করছে বন্দর।। শিপিং এজেন্টদের তীব্র প্রতিক্রিয়া

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৯ জুন, ২০২১ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

বড় ধরনের সংস্কার কাজ শুরু করায় চট্টগ্রাম বন্দরের পাঁচ জেটিতে এক মাসের জন্য স্ক্র্যাপসহ ভারি পণ্যবাহী জাহাজ বার্থিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের ব্যবহারে জেটিগুলোতে বড় বড় গর্তসহ ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ চল্লিশ বছরের বেশি পুরানো জেটিগুলো সংস্কারে হাত দেয়। অপরদিকে এক মাস জাহাজ বার্থিং বন্ধ রাখার খবরে শিপিং এজেন্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, কোন ধরনের আগাম প্রস্তুতি ছাড়া এই ধরনের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা কোটি কোটি টাকার ক্ষতির পাশাপাশি বিশ্বের শিপিং সেক্টরে বন্দরের ইমেজ নষ্ট হবে। তারা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহবান জানিয়েছেন। বন্দরে খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং এর জন্য ছয়টি জেটি নির্দিষ্ট করা আছে। বন্দরের এক নম্বর থেকে ছয় নম্বর পর্যন্ত জেটিগুলোতে খোলা পণ্যবাহী জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়। এরমধ্যে এক নম্বর জেটির নাব্যতা কমে যাওয়ায় এটিতে বড় জাহাজ বার্থিং দেয়া সম্ভব হয়না। অন্যান্য জেটিগুলোতে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা জাহাজ বার্থিং দিয়ে পণ্য খালাস করা হয়। ১৯৭৭-১৯৭৮ সালে জেটিগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৮১ সালে। সেই তখন থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে এসব জেটি। বড় ধরনের কোন সংস্কার বিগত সময়ে করা হয়নি। দীর্ঘদিনের বহুমুখী ব্যবহারে জেটিগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। প্রতিটি জেটিতে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা তৈরি হয়েছে।
জেটিগুলোতে তৈরি হওয়া গর্তের নিচে খরস্রোতা কর্ণফুলী। কেউ পড়ে গেলে তাকে খুুঁজে পওয়াও কঠিন হবে। উল্লেখ্য, নদীর বেশ গভীর পর্যন্ত পাইলিং এবং পিলার তৈরি করে পাটাতন তৈরির মাধ্যমে জেটি নির্মাণ করা হয়। এতে উপর দিয়ে রাস্তা এবং ইয়ার্ড দেখা গেলেও নিচে খরস্রোতা নদী। নদীর উপর ছাদ নির্মাণের মাধ্যমেই মুলত জেটি তৈরি করা হয়। আর ছাদ ভর্তি গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় পুরো জেটিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে কোন সময় বড় ধরনের অঘটনের আশংকাও প্রকাশ করা হচ্ছিল গত বেশি কিছুদিন ধরে। এই ব্যাপারে দৈনিক আজাদীতে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে জেটিতে ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, জাহাজ বোঝাই করে বিদেশ থেকে আনা স্ক্র্যাপ এবং কাঠসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী পণ্য খালাসকালে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত এসব কাজের ফলে জেটিতে শুধু গর্তই সৃষ্টি হয়নি, বিভিন্ন স্থানে জেটিতে ফাটলও দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে জেটিগুলো শুধু ব্যবহারকারীদের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ নয়, জেটিগুলোর অস্থিত্বও হুমকির মুখে পড়ে। জেটিতে বড় ধরনের ধস বা ভেঙ্গে পড়ার আশংকাও তৈরি হয়।
এই অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত শনিবার থেকে বড় ধরনের সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিটি গর্ত নতুন করে ঢালাই দেয়ার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। আরসিসি ঢালাই দিয়ে জেটির পাটাতন মেরামত কাজ শুরু করা হয়। এজন্য গত শনিবার থেকে আগামী এক মাসের জন্য বন্দরের এক নম্বর থেকে পাঁচ নম্বর জেটিতে স্ক্র্যাপসহ ভারি পণ্যবাহী জাহাজ বার্থিং নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, জেটিগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়লে পুরো বন্দর কলাপসড করবে। তাই সতর্কতা হিসেবে বড় ধরনের ক্ষতির আগেই জেটি মেরামতে হাত দেয়া হয়েছে। তাই জাহাজ থেকে পণ্য হ্যান্ডলিং করার কোন সুযোগ নেই।
তবে জেটিতে জাহাজ নোঙর করে নদীর দিকে লাইটারেজ জাহাজ লাগিয়ে কেউ যদি ওভার সাইটে পণ্য খালাস করতে চায় তাহলে বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেবে। এছাড়া হালকা কোন পণ্য নিয়ে আসা জাহাজকে পণ্য খালাস করতে দেয়া হবে। কিন্তু স্ক্র্যাপ বা ভারি পণ্য খালাস করার কোন সুযোগ নেই।
এক নম্বর থেকে ৫ নম্বর জেটিতে স্ক্র্যাপ জাহাজ বার্থিং বন্ধ করে দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত এক পত্রে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন। পত্রে বলা হয়েছে যে, কোন ধরনের আগাম ঘোষণা এবং প্রস্তুতি ছাড়া এই ধরনের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা কোটি কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়বে। আউটারে স্ক্র্যাপ নিয়ে আসা তিনটি জাহাজ এবং পাইপ লাইনে আরো জাহাজ থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব জাহাজ পণ্য খালাস করতে না পারলে শিল্পে কাঁচামালের সংকট দেখা দেবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের এই ধরনের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে বন্দরের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মন্তব্য করেন।
অবশ্য শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জেটি সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় কাজে হাত দেয়া হয়েছে। বিষয়টি সবাই জানে। তাছাড়া বন্দরের জেটিগুলো সংস্কার করা না হলে বড় ধরনের অঘটনে পুরো জেটি বন্ধ হয়ে গেলে তখন সংকট আরো প্রকট হবে।
বন্দরের কর্মকর্তারা বলেন, জেটি বন্ধ করা হলেও স্ক্র্যাপ খালাসের বিকল্প ব্যবস্থা আছে। আউটারে লাইটারেজ জাহাজে স্ক্র্যাপ খালাস করার সুযোগ রয়েছে। সদরঘাট জেটিতে স্ক্র্যাপ খালাস করা হয়। এছাড়া ড্রাইডকের জেটিতেও স্ক্র্যাপ খালাসের সুযোগ রয়েছে। স্ক্র্যাপ বা ভারি পণ্যবাহী জাহাজগুলো সাময়িকভাবে ড্রাইডক জেটিতে হ্যান্ডলিং করলে কারো কোন সংকট হবে না। লাইটারেজ জাহাজে স্ক্র্যাপ খালাস করা হলে খরচ কিছুটা বাড়লেও সংকট হবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক সংস্কার কাজের জন্য জেটিতে জাহাজ বার্থিং সাময়িক বন্ধ রাখার কথা স্বীকার করে বলেন, জেটি পুরোপুরি বন্ধ বলা ঠিক হবে না। আমরা শুধু স্ক্র্যাপ এবং ভারি পণ্যবাহী জাহাজ বার্থিং দিচ্ছি না। এক মাসের মধ্যেই জেটিগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলবে। তিনি স্ক্র্যাপ এবং ভারি পণ্যবাহী জাহাজগুলো যাতে কোন সমস্যায় না পড়ে সেজন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে বলেও উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড এডমিন) মোহাম্মদ জাফর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যবসা বাণিজ্য বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্ক্র্যাপের গুরুত্ব অপরিসীম। সবই ঠিক আছে। স্ক্র্যাপ খালাসের জন্য বিকল্প আছে। বহু সুযোগ আছে। আউটারে স্ক্র্যাপ খালাস করার সুযোগ আছে। চিটাগাং ড্রাইডক এবং বেসরকারি জেটিতেও সুযোগ আছে। বন্দরের জেটির কাজ করলে দেশে স্ক্র্যাপ খালাস বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি কখনো হবে না।
মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, সবকিছুর আগে আমাদেরকে জেটির নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। জেটি যদি নিরাপদ এবং সুষ্ঠু না থাকে, পুরো জেটি যদি বন্ধ করে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে আমাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। আমাদেরকে জেটি মেরামতের সুযোগ দিতে হবে। এগুলো পুরানো জেটি, তাই মেরামত না করলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুলিশ দেখে পালাল বর-কনেসহ অতিথিরা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে সাড়ে সাত লাখ কোরবানির পশু মজুদ