পটভূমি: ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ ভোরবেলা। ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্ণেল শাফায়াত জামিল বীর বিμম। তাঁরই অধীন ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডার মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর আবদুল হাফিজ (জোর করে সাথে নিয়ে গেছে) কে নিয়ে তীব্র কষাঘাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলল শাফায়াত জামিলকে। রশীদ বলল, আমরা রাষ্ট্রপতিকে খুন করে এসেছি। তিনি কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ ও স্তম্ভিত এরপর থেকে শাফায়াত পাল্টা অভ্যুখানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। সাথে পেয়ে গেলেন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল ও সেনাপ্রধান)।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ১ম ঘটনা: ভোর রাত ১ টা। বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল মেজর ইকবালের ইউনিট। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো সেনা ইউনিট নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে রাখা বাসে করে ফিরে এলেন সেনানিবাসে। অরক্ষিত বঙ্গভবনে রইলো খন্দকার মোশতাক, খন্দকার আবদুর রশীদ, অন্যান্য খুনীদের নিয়ে তার কয়েকটি ট্যাঙ্ক ও সামান্য কিছু সৈন্যসহ মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। রশীদরা বুঝল, পাল্টা অভ্যুথান শুরু হয়ে গেছে। শুরু হল রশীদের সাথে খালেদ মোশাররফের টেলিফোন বাকযুদ্ধ। খালেদের এক কথা তোমরা আত্মসমর্পণ কর নতুবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবী।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ২য় ঘটনা: পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার মোসলেউদ্দীন ৪ জনকে সাথে নিয়ে হাজির হল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
জেলার আমিনুর রহমানকে গেট খুলে দেয়ার জন্য বলা হল। ভোর রাত ১.৩০ টা। জেলার আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামান হাওলাদার ও ডিআইজি (প্রিজন) আবদুল আউয়াল (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের পিতা) কে বিষয়টি জানালে, তাঁরা ত্বরিত জেল অফিসে ঢুকলেন। টেলিফোন এল। প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিলেন ওরা যা করতে চায়, করতে দাও। খুলে গেল জেল গেট। খুনীরা একটি স্লিপে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহম্মদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে একটি কক্ষে জড়ো করার জন্য হুকুম দিল। আইজি (প্রিজন) কেন চার জনকে আলাদাভাবে একত্রিত করতে হবে প্রশ্নের উত্তরে খুনীরা বলল, তাদের হত্যা করা হবে।
চারজনকে এক কক্ষে ঢুকানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হল ব্রাশ ফায়ার। ২ জন তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান। বাকী ২ জনকে পুনরায় এসে গুলি ও বেয়নেট চার্জে হত্যা করা হল। খুনীরা জীপটি নিয়ে দ্রুত অরক্ষিত বঙ্গভবনে চলে এল। তখন ভোররাত আনুমানিক ৪ টা।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ৩য় ঘটনা: জেল কর্তৃপক্ষ তখনো জানে না খালেদ মোশাররফ-শাফায়াতের অভ্যুখান সফলতার পথে। তারা এটাও জানে না মোশতাক-ফারুক-রশীদ বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পথে। জেল হত্যার বিষয়টি জানানো হয়েছিল সিডিএস মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। সকাল বেলা মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানীও বঙ্গভবনে এসে ঘটনা শুনলেন। ওসমানী ও খলিল কেউ জেল হত্যার বিষয়টি খালেদ-শাফায়াতকে জানালেন না। ভোর হতেই ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট লিয়াকতের নেতৃত্বে বঙ্গভবনের উপর চক্কর লাগানো মিগ-২৯ ফাইটার। খুনীরা পরাজয় মেনে নিল। ওসমানী মোশতাক সহ খুনীদের দেশ ত্যাগের সুযোগ চাইলো। ঐ সময় কর্ণেল তাহেরও বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন (সূত্র: প্রতিনায়কঃ মহিউদ্দিন আহমেদ)। সারাদিন টেলিফোনে চললো ওসমানীর দুতিয়ালী। বিদেশী রাষ্টদূতদের অনেকেই বলল, আপনাদের আমরা মেনে নিলাম তবে মোশতাক সহ খুনীদের নিরাপদ দেশত্যাগের পরামর্শ দিলেন। থাইল্যান্ড ভিসা দিতে সম্মত হলো। খালেদের নির্দেশে বিমান বাহিনী বললো সন্ধ্যার পর যে কোন সময় তারা খুনীদের বার্মার উপর দিয়ে থাইল্যান্ড নিয়ে যেতে পারবে। অন্য খুনীদের দেশ ত্যাগে খালেদ রাজি হলেন কিন্তু মোশতাককে যেতে দিতে অস্বীকার করলেন। বেঁকে বসলেন রক্ষী বাহিনী প্রধান কর্ণেল নুরুজ্জামান। তাঁর এক কথা বিমান উড়ার সাথে সাথে এন্টি এয়ার μাফট কামান দিয়ে বিমানটিকে ভূপাতিত করে খুনীদের হত্যা করবেন।
খালেদের এক কথা তিনি আর রক্তপাত চান না। অগত্যা ৩ নভেম্বর দিবাগত রাত ১০ টায় মহিউদ্দিন ছাড়া বাকী ১৭ জনকে নিয়ে বিমান উড়াল দিল থাইল্যান্ডের পথে। ফলাফল, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের নগ্নরূপ। ৩ নভেম্বর ভোর হওয়ার আগে রাত ১ টা থেকে পুরোদিন এবং খুনীরা উড়াল দেয়ার আগ পর্যন্ত খালেদ শাফায়াত নুরুজ্জামান বা অভ্যুখানকারীদের কেউ জানলো না বা ওসমানী ও খলিলুর রহমান জেল হত্যার বিষয়টি খালেদ-শাফায়াতকে জানালো না। আরো মর্মান্তিক হলো ৩ নভেম্বর পুরোদিন পুরো রাত্রি ৪টি লাশই পড়ে রইলো জেলের ভিতর। ওদের পরিবারকেও কিছুই জানানো হল না। পরদিন ৪ঠা নভেম্বর কারা কর্র্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ইএ চৌধুরী বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে বুঝতে পারলেন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ৩ তারিখেই খালেদ শাফায়াতের হাতে চলে গেছে। ৪ নভেম্বর সকালবেলা তিনি খালেদের সাথে দেখা করতে সেনানিবাসে গেলেন। খালেদ ইএ চৌধুরীকে সাথে নিয়ে শাফায়াতের অফিস কক্ষে ঢুকলেন এবং ইএ চৌধুরী ৩ নভেম্বর জেল হত্যার খবরটি সবিস্ত্তারে বর্ণনা করলেন। শাফায়াতের মতে তখন সকাল দশটা। অফিস কক্ষে সমস্ত্ত অফিসাররা স্ত্তম্ভিত হয়ে গেল। ওসমানী আর খলিলের চতুরাতার কারণে খুনীরা জেল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও নিরাপদে দেশত্যাগ করতে পারল। খলিলুর রহমান পাকিস্তান ফেরৎ অফিসার ছিলেন। কিন্তু ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন। অথচ জাতীয় ৪ নেতার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি পুরো ১ দিন গোপন রেখে এই জাতির সাথে এক অমার্জনীয় অপরাধ করে গেছেন।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ভোর রাত ১টার দিকে অভ্যুখান শুরুর সাথে সাথে মেজর হাফিজের (বর্তমান বিএনপি নেতা) নেতৃত্বে সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়। জিয়াকে বা তার পরিবারের কারো কোনো ক্ষতি করা হয় নি। মেজর নাসির, কর্ণেল জাফর ইমাম সহ সবাই বলছেন, জিয়ার শারীরিক কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা অভ্যুখানকারীদের ছিল না।
ঘটনার ২ দিন আগে চাইনিজ হোটেলের চূড়ান্ত বৈঠকে জিয়াকে হত্যার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। খালেদ প্রস্ত্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, বহু রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের রক্ত দাগ এখনো শুকায় নি। আমি আর কোনো রক্তপাত চাই না। ভুলের মাশুল; জেনারেল আইয়ুব এবং জেনারেল ইয়াহিয়াও রক্তপাতহীন অভ্যুখানের মধ্য দিয়ে পাকিস্ত্তানের ক্ষমতায় মালিক হয়েছিলেন। বুঝা যাচ্ছে, খালেদের মনোজগতে ঐসব রক্তপাতহীন অভ্যুখানের সাফল্য প্রভাব ফেলেছিল। অথচ তাঁর খেয়াল ছিল না যে রাষ্ট্রপতি ইসকান্দর মীর্জাকে অপসারণের সময় তিনি সামরিক বাহিনীর কমান্ডে ছিলেন না, ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত। জেনারেল আইয়ুবকে জোর করে হঠাতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চাপের কাছে নথি স্বীকার করে আইয়ুব নিজেই ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবার সময় বলেছিলেন, পাকিস্ত্তান ভেঙে যাবার কর্মকাণ্ডে আমি আর সভাপতিত্ব করতে চাই না। ৩ নভেম্বর জিয়া ছিলেন দেশের প্রধান সেনাপতি এবং সেনাপ্রধান পদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে খালেদ ভুল মূল্যায়ন করেছেন এবং জীবন দিয়ে তার খেসারত দিয়েছেন। লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট