বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ৩ আগস্ট রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক বিশাল সমাবেশে তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম বিকেল ৫টার দিকে সর্বস্তরের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে এই ঘোষণা দেন এবং শেখ হাসিনার সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন।
এর আগে সকালে, শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, গণভবনের দরজা খোলা। আমি আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে বসতে চাই এবং তাদের কথা শুনতে চাই। আমি কোনো সংঘাত চাই না। তবে শেখ হাসিনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে নাহিদ বলেন, তারা শুধু শেখ হাসিনার নয়, সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করছেন। তারা আন্দোলনের সময় সকল হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের জন্য শেখ হাসিনার বিচারের দাবিও জানান। খবর বাসসের।
তিনি উল্লেখ করেন, তারা এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চান যেখানে স্বৈরাচার আর কখনো যেন ফিরে আসতে না পারে, এবং তিনি জনগণকে দেশব্যাপী ছাত্র–জনতার গণ–জাগরণে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। নাহিদ আরও ঘোষণা করেন, তারা সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করবেন এবং সবাইকে ৪ আগস্ট থেকে তাদের পূর্বঘোষিত সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। সমাবেশটি সন্ধ্যা ৬টার দিকে শেষ হয়। বিক্ষোভকারীরা টিএসসি এলাকায় জড়ো হয়ে রাজু ভাস্কর্যের চোখ লাল কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়। পরে বিক্ষোভকারীরা সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে।
এছাড়া আন্দোলনের আরেক প্রধান সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়াও অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে জনগণের জন্য ১৫ দফা ঘোষণা দেন। দফাগুলো ছিল : কেউ কর দেবে না, কেউ কোনো ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করবে না, সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত, কল–কারখানা বন্ধ থাকবে, মানুষ অফিসে যাবে না তবে মাস শেষে বেতন সংগ্রহ করবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাবে না, জনগণ সব ধরনের সরকারি সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠান বয়কট করবে, বন্দরের শ্রমিকরা কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবে না বা কাজ করবে না, দেশের সকল কল–কারখানা বন্ধ থাকবে, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কাজে যাবে না, গণপরিবহন চলবে না, শ্রমিকরা কাজে যাবে না, ব্যাংক শুধু রোববার জরুরি লেনদেনের জন্য খোলা থাকবে, পুলিশ সদস্যরা শুধু থানায় নিয়মিত দায়িত্ব পালন করবে, কোনো প্রটোকল, বিক্ষোভ দমনে দায়িত্ব পালন করবে না, এক টাকাও পাচার হবে না এবং কোনো অফশোর লেনদেন হবে না, বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্য বাহিনী ব্যারাকের বাইরে কোনো দায়িত্ব পালন করবে না, বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও উপকূলীয় এলাকায় থাকবে, আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা কর্মকর্তারা অফিসে যাবেন না, বিলাসবহুল পণ্যের দোকান, শো–রুম, দোকান–পাট, হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকবে।
এর আগে, সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে আসতে শুরু করে, তারা জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন এবং জনস্রোত দোয়েল চত্বরের পূর্ব, জগন্নাথ হলের পশ্চিম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেটের দক্ষিণ এবং শিববাড়ী মোড়ের উত্তর পাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই এলাকাগুলো ‘দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
এদিন চট্টগ্রামে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাসভবনে হামলা হয়। বাসার সামনে পার্ক করা দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চট্টগ্রাম–১০ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর লালখান বাজারে অবস্থিত কার্যালয়েও হামলা হয় এবং কার্যালয়টিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।