চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সিএমএসডির (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার) গোডাউনে পড়ে থাকা প্রায় হাজার টন ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাফেনাইল ট্রাইক্লোরে ইথেন) অবশেষে অপসারণ শুরু হচ্ছে আজ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব দ্যা ইউনাইটেড নেশনস (এফএও)-এর তত্ত্বাবধানে এই রাসায়নিক অপসারণ করা হচ্ছে। আজ শনিবার সকালে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিষাক্ত রাসায়নিক অপসারণের কাজ শুরু করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির ঢাকাস্থ কার্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড লার্নিং স্পেশালিস্ট এহসান কবির।
এই ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাফেনাইল ট্রাইক্লোরে ইথেন) শুটকিতে এবং কৃষিকাজে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বিবেচনায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বর্তমানে ডিডিটির উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। চট্টগ্রামের গোডাউনে মজুদের ৩৬ বছর পর নিষিদ্ধ এই রাসায়নিকের অপসারণ কাজ শুরু হচ্ছে। এফএও-এর সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজর ও ডিডিটি অপসারণ প্রকল্পের পরিচালক সাসো মার্টিনভ জানান, এই ডিডিটি অপসারণ করে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হবে। জলপথে বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এসব রাসায়নিক নিয়ে যাওয়া হবে। পথে ১২টি দেশের বন্দর হয়ে শেষ গন্তব্য ফ্রান্সে পৌঁছাবে ওই জাহাজ। প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসব ডিডিটি অপসারণে গ্রীসের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ করানো হয়েছে। প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে বিশেষ জাহাজে এসব রাসায়নিক বহন করা হবে। বহনে বা কন্টেনারে উত্তোলনের সাথে জড়িত কর্মীদের বিশেষ পোশাক থাকবে। অপসারণের সময় নির্দিষ্ট এলাকা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
এই ডিডিটি অপসারণে তিন-চার মাস সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এফএওসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এই ডিডিটি অপসারণ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
এর আগে গত ২৭ নভেম্বর নগরীর একটি হোটেলে এই ডিডিটি অপসারণ সংক্রান্ত এক কর্মশালার আয়োজন করে এফএও। ওই কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) মো. মনিরুজ্জামান, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিন তালুকদার। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে কর্মশালায় বিশেষ বক্তব্য রাখেন এফএও-এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসন ও সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজর সাসো মার্টিনভ।
কর্মশালায় জানানো হয়, ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে। ম্যালেরিয়া নির্মূলে মশক নিধনের উদ্দেশ্যে এ রাসায়নিক আমদানি করা হয়। কিন্তু এরপর থেকে চট্টগ্রামের ওই গোডাউনেই তা মজুদ রয়েছে। পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে মজুদসহ এখানে মোট মজুদের পরিমাণ প্রায় হাজার টন বলে কর্মশালায় জানানো হয়। যদিও বর্তমানে মজুদ থাকা ডিটিটির পরিমাণ ৫০০ মেট্রিক টনের বেশি হবে না বলে জানান, গোডাউন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা।
কর্মশালায় আরো জানানো হয়, ২০০১ সালে স্টকহোম কনভেনশনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বা সীমিতকরণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৭১টি দেশ তাতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ২০০১ সালের ২৩ মে। আর কার্যকর করে ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। কিন্তু চুক্তি কার্যকরের প্রায় ১৪ বছর পরও ক্ষতিকর এই রাসায়নিক অপসারণ করতে না পারায় আফসোস ঝরে পড়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামালের বক্তব্যে। মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৪ বছর ধরে এটি সরানো নিয়ে আমরা যুদ্ধ করছি। কিন্তু এত বছর কেন লাগবে, তা বুঝতে পারছি না। এতদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব এগুলো অপসারণ হোক। একদিনও যদি দেরি হয়, তাতে আরো ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এই ডিডিটি দ্রুত অপসারণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করণীয়, তাতে একটুও বিলম্ব হবে না বলে আশ্বস্ত করেন সচিব মো. মোস্তফা কামাল। বক্তব্যের শুরুতে ডিডিটি অপসারণে পুলিশ, জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন, বন্দর-কাস্টমসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরের প্রতিনিধি যুক্ত করার নির্দেশনা দেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলে মশক নিধনের জন্য ৩৬/৩৭ বছর আগে এই ডিডিটি আমদানি করা হয়েছিল। এর মাঝে ১৯৯১ সালে ঘুর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম প্লাবিত হয়। ওই সময় অনেক রাসায়নিক পানির সাথে মিশে গেছে। যা মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে।