যান্ত্রিক ত্রুটিতে গত বছরের নভেম্বর থেকে প্রায় ৭ মাস ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের ম্যামোগ্রাফি মেশিন। নারীর স্তনে টিউমার, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক এই যন্ত্র। এর আগে পরীক্ষার অপরিহার্য উপকরণ ফিল্ম (নেগেটিভ) সংকটেও প্রায় ৮ মাস অচল ছিল মেশিনটি। তবে প্রায় ৮ মাস পর মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একশ ফিল্ম যোগাড় করতে সক্ষম হয় হাসপাতাল প্রশাসন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর এই একশ ফিল্ম বুঝে পায় হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ। কিন্তু সবশেষ ফিল্ম যোগাড় হলেও কোটি টাকার মেশিনটি ঘিরে জটিলতা কাটেনি। ফিল্ম যোগাড়ের পর চালু করতে গেলে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় মেশিনটিতে। ফিল্ম সংকটে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় মেশিনটি চালু করতে জটিলতা দেখা দেয় জানিয়ে রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার তখন আজাদীকে বলেন, মেশিনটি অনেকদিন বন্ধ ছিল। মেশিনারিজ বা কোনো যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অচল থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ওই মেশিনে কিছু না কিছু সমস্যা হতে পারে। ম্যামোগ্রাম মেশিনটিও চালু করতে গিয়ে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চালু করা সম্ভব হয়নি। রেডিওলজি বিভাগের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফিল্ম সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সব মিলিয়ে টানা ১৫ মাস ধরে অকেজো হয়ে আছে ম্যামোগ্রাম মেশিন। এর আগেও মেশিনটি যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা জটিলতায় দফায় দফায় অকেজো হয়ে পড়েছিল। রেডিওলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ মেশিনের সেবা চালু করা হয়। তবে উদ্বোধনের পর থেকে মেশিনটি সব মিলিয়ে তিন মাসও সচল থাকেনি। ক’দিন যেতে না যেতেই অকেজো হয়ে পড়ে। হিসেবে দেখা যায়, সেবা চালুর ৩৩ মাসের মধ্যে ৩১ মাসই অচল ছিল কোটি টাকার এ মেশিন।
মেশিনটির দীর্ঘ সময় ধরে অকেজো থাকার বিষয়টি স্বীকার করে রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার আজাদীকে বলেন, অনেকদিন ধরে মেশিনটি অকেজো পড়ে আছে। মেশিনে যান্ত্রিক কোনো ক্রটি দেখা দিলে তা সারানোর দায়িত্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। মেশিন অকেজো থাকার বিষয়টি আমরা চিঠির মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগযোগ করে থাকেন। তবে আমরা যেটা দেখেছি, দফায় দফায় যোগাযোগ করেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এখন মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও (সময়সীমা) শেষের পথে।
গত বছর মেশিনটি চালু করতে না পারার বিষয়টি অবগত হয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয় জানিয়ে হাসপাতালের তৎকালীন উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম ওই সময় বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাওয়া যায় না। মেশিনের ত্রুটি খতিয়ে দেখতে কয়েকবার লোক পাঠানোর কথা বললেও তারা আসেনি।
বর্তমানেও অকেজো থাকার বিষয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর আজাদীকে বলেন, মেশিনটি অনেকদিন ধরে অকেজো হয়ে আছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির সাথে যোগাযোগ করেছি। বিষয়টি দেখছি, কী করা যায়।
হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, মেশিনটি স্থাপন থেকে শুরু করে ফিল্ম সংকট এবং ফিল্ম যোগাড় পরবর্তী মেশিন চালু করতে না পারাসহ সার্বিকভাবে মেশিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষতার কারণেই মেশিনটির সেবা চালু করতেও বিলম্ব হয়। পরে ফিল্ম সংকটেও ভুগতে হয়। দফায় দফায় যোগাযোগ করেও তাদের কাছে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। অদক্ষতার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে হাসপাতাল প্রশাসন। তবে ওই সময় অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করেন মেশিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিউটেক জিটি লিমিটেডের ম্যানেজার সাইদুজ্জামান।
সাইদুজ্জামান বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নেই। যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির সম্মানিক (অনারারি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোহন্ত গতকাল আজাদীকে বলেন, এত দীর্ঘ সময় মেশিন অকেজো থাকার বিষয়টি অনেকটা অস্বাভাবিক লাগছে। এ রকম হওয়ার কথা না। আমাকে কাগজপত্র দেখতে হবে। তবে যদি সমস্যা থাকে, সেটি আমি দেখছি।
নিউটেক জিটি লিমিটেডের সম্মানিক চেয়ারম্যানের সাথে কথা শেষ হওয়ার পরপর কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী কমল কৃষ্ণ মজুমদারের সাথে। তিনি দাবি করেন, বোর্ড নামে মেশিনটির একটি ডিভাইস প্রয়োজন ছিল, যা লকডাউনের কারণে পেতে বিলম্ব হয়েছে। তবে সমপ্রতি ডিভাইসটি তারা হাতে পেয়েছেন। আর যানবাহনও যেহেতু চলাচল করছে, এক সপ্তাহের মধ্যে মেশিনটি তারা সচল করার ব্যবস্থা নেবেন।
হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের তথ্য মতে, রেডিওলজি বিভাগে সিঙ্গল (একটি) স্তনের ম্যামোগ্রাফ টেস্টে ৪০০ টাকা এবং ডাবল (দুটি) স্তনের টেস্টে ফি ৮০০ টাকার বেশি নেয়। কিন্তু প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এই টেস্ট ফি সিঙ্গল টেস্টে দেড় হাজার এবং ডাবল স্তন টেস্টে তিন হাজার টাকার কম নয়।
প্রসঙ্গত, চমেক হাসপাতালে আনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট সেবা চালু হয় কোটি টাকা মূল্যের ম্যামোগ্রাফি মেশিনটির। তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে মেশিনটির সেবা উদ্বোধন করেন। আনুষ্ঠানিক সেবা চালুর পর প্রথম কিছুদিন খুব কম সংখ্যক রোগী পাওয়া যায় ম্যামোগ্রাফ করানোর। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ‘কোটি টাকার মেশিন আছে, রোগী নাই/সচেতনতার অভাবে স্তন ক্যান্সার পরীক্ষায় আগ্রহী নন নারীরা’ শিরোনামে আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকে মেশিনটির সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়তে থাকে বলে নিশ্চিত করেন হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। তবে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও মাস যেতে না যেতেই অচল হয়ে পড়ে কোটি টাকার মূল্যের মেশিনটি।
পরীক্ষার অপরিহার্য উপকরণ ফিল্ম না থাকায় ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে মেশিনটি ফের অকেজো হয়ে পড়ে। এ নিয়ে ওই বছরের ১৩ মে ‘ফিল্ম সংকটে অচল/কোটি টাকার ম্যামোগ্রাফি মেশিন’ শিরোনামে আজাদীর প্রথম পাতায় আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে রেডিওলজি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলেন, মেশিনের প্রিন্টারটি ইউএসএর কর্ডেনিঙ ব্র্যান্ডের। পরীক্ষার জন্য একই ব্র্যান্ডের ফিল্ম বা নেগেটিভ প্রয়োজন। কিন্তু এই ব্র্যান্ডের ফিল্ম বাজারে পাওয়া যায় না। কেবল মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকেই এ ফিল্ম সংগ্রহ করার বা কেনার সুযোগ রয়েছে।
মেশিনটির সেবা চালুর সময় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ৬০০ পিস ফিল্ম দেওয়া হয় রেডিওলজি বিভাগে। যা শেষ হওয়ার পর থেকে মেশিনটির সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পাওয়ার কথা জানিয়েছিল হাসপাতাল প্রশাসন।
সর্বশেষ গত বছরের ৩১ অক্টোবর একশটি ফিল্ম যোগাড় করতে সমর্থ হয় হাসপাতাল প্রশাসন। কিন্তু ফিল্ম যোগাড়ের পরও মেশিনটি চালু করা যায়নি। দীর্ঘদিন অচল থাকায় মেশিনটিতে যান্ত্রিক ক্রটি দেখা দেয় বলে জানান রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসকরা।
উল্ল্লেখ্য, নারীর স্তনে টিউমার, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় ম্যামোগ্রাফি মেশিন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্তন পরীক্ষায় এমন অত্যাধুনিক যন্ত্র পায়নি চমেক হাসপাতাল। তবে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য একটি করে মেশিন বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতালি থেকে আমদানি করা দুটি মেশিনের খরচ পড়ে ৩ লাখ ৮১ হাজার ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা তিন কোটি ৩২ লাখ ৩ হাজার ৯২১ টাকা। হিসেবে প্রতিটির মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু কোটি টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক এ যন্ত্র চমেক হাসপাতালে বাঙবন্দি ছিল প্রায় বছর ধরে। হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের একটি ছোট্ট কক্ষে এমন অবস্থায় পড়েছিল মেশিনটি।
রেডিওলজি বিভাগ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টলেশন (চালুর জন্য প্রস্তুত) সম্পন্ন না করায় মেশিনটির সেবা চালু করা সম্ভব হয়নি। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহের পর চালুর জন্য মেশিনটি ইনস্টলেশনসহ আনুষঙ্গিক সবই করে দেওয়ার কথা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর আজাদীতে ‘বাঙে বন্দি কোটি টাকার ম্যামোগ্রাফি মেশিন, চমেক হাসপাতালে সেবা চালু করা যায়নি এক বছরেও!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরপর আরো বেশ কয় মাস কেটে গেলেও মেশিনটির সেবা চালু করতে পারেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুন আজাদীর প্রথম পাতায় ‘কোটি টাকার ম্যামোগ্রাফি মেশিন চালু হবে কবে? সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অবশেষে হাসপাতালে আনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট মেশিনটির আনুষ্ঠানিক সেবা চালু করা হয়। কিন্তু চালুর ৩৩ মাসের মধ্যে ৩১ মাসই অচল হয়ে পড়েছিল এ মেশিন।