বাংলাদেশের আর দশটি ইউনিয়নের মতোই সাধারণ বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর–খরণদ্বীপ ইউনিয়নটি। কিন্তু এটি অনন্য হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। ইউনিয়নটি ধরে রেখেছে শত বছরের পুরনো একটি স্মৃতি। যা গৌরব আর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বছরের পর বছর। প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে শনের ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি মসজিদ। যার নাম শ্রীপুর বুড়া মসজিদ। শত শত বছর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে আসছেন। স্থাপত্য নিদর্শনটি নির্মাণকাল থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে ১৪২টি খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে দুই তলা বিশিষ্ট এই মসজিদ। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে উপজেলা সদর থেকে সিএনজি টেক্সি যোগে কানুনগোপাড়ার উত্তরে শ্রীপুর–খরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের সামনে মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে মসজিদে গিয়ে পৌঁছলাম। মসজিদে ঢুকতেই দেখা যায় ৮০ ফুট উচ্চতার একটি মিনার স–গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দৈনিক পাঁচবার এই মিনার থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে যায় অনেকদূর পর্যন্ত। মসজিদের পাশে আছে শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় সকাল ১১টা থেকে দূর–দূরান্ত থেকে হাজারো মুসল্লিকে মসজিদে আসতে দেখা যায়।
বাইরে দেখা হয়ে গেল মসজিদের মোতোয়াল্লি মো. নুরুন্নবী চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি এই মসজিদে প্রায় ৩০ বছর ধরে খেদমত করে আসছেন। তাকে নিয়ে মসজিদে ঢুকতেই সামনের তোরণটি চোখে পড়ে, যেটি নির্মিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে। ঘুরে দেখা যায়, ভিতরে–বাইরে ২৪টি জানালা ও একটি মিম্বর রয়েছে। মসজিদের পশ্চিমে রয়েছে ২৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭০ ফুট প্রস্থের একটি ইদগাহ। মসজিদের দক্ষিণে বিশাল কবরস্থান, যে কবরস্থানে অনেক বুজুর্গ ব্যক্তিকে কবরস্থ করা হয়েছে। মসজিদ, কবরস্থান ও পুকুরসহ প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই মসজিদটি। মসজিদের পাশে রয়েছে নুরুল্লা মুন্সির হাট, যা নলা মুন্সির হাট নামে বেশি পরিচিত। বাজারে হাঁস, মুরগিসহ হরেক রকমের পাহাড়ি তাজা শাক–সবজি পাওয়া যায়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে মহিলাদের বসার স্থান। প্রতি শুক্রবার প্রায় ৪শ মহিলার সমাগম হয় এখানে।
জুমার নামাজ শেষে নিজ কার্যালয়ে বসে কথা হয় মোতোয়াল্লী নুরুন্নবী চৌধুরীর সঙ্গে। মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বললেন, এ মসজিদ কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার নির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ কারো জানা নেই। এখন থেকে ৩০০ বছর পূর্বে মোঘল আমলের শেষ দিকে এটি নির্মিত হয় বলে অনেকেরই ধারণা। প্রথম পর্যায়ে একটি বট গাছের নিচে এক বুজুর্গ ব্যক্তি নামাজ আদায় করতো। পরবর্তীতে কুঁড়ে ঘরে গায়েবি আজান পড়ত নিয়মিত, এমনটা শুনেছি এলাকার মুরব্বিদের থেকে। চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রশাসক ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বলে জানা যায়। তার দাদা শেখ নাছির উদ্দিন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের গৌড় এলাকা থেকে এ এলাকায় দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। শ্রীপুর তখন থেকে ছিল অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। বর্তমানেও মসজিদের উত্তরে হিন্দু ও দক্ষিণে বড়ুয়া পাড়া। শেখ নাছির উদ্দিন তাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করে দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তার অধস্তন পুরুষ থানাদার দীক্ষিত লোকদের পাঞ্জাগানায় নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প কজন মুসল্লী নামাজ পড়ার মত জায়গা নিয়ে শন পাতার বেড়া এবং উপরে দু’নালি শন দিয়ে মসজিদের প্রথম ঘর নির্মিত হয়। ঝোঁপ–ঝাঁড়ের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এ মসজিদে মুসল্লীরা রাতে নামাজ আদায় করতে পারত না। নিরাপদ দূরত্বে থেকে মুসল্লীরা আজান দিয়ে চলে যেত। পরবর্তীতে চারপাশে বাঁশের বেড়া এবং উপরে শনের ছাউনি দিয়ে ১০–১৫ হাত লম্বা চওড়া করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। খুব সম্ভবত ১৮৮৬ সালে বেড়া ও শনের ছাউনি ঘর ভেঙে যায় প্রবল ভূমিকম্পের কারণে। ভাঙা অবস্থায় জোড়া তালি দিয়ে ২০–২৫ বছর চলছিল এ মসজিদের কার্যক্রম। এরপর গুদাম তৈরি হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে চলে আসে এ পর্যন্ত।
মসজিদের নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, ওয়াসিন চৌধুরীর পিতা একজন ইবাদত–গুজার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইবাদত বন্দেগীতে এতই মশগুল থাকতেন যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কোনো খবর রাখতেন না। তিনি বুড়ো বয়সে ঐ মসজিদে নামাজ ও যিকির–আজকারে দিন রাত কাটিয়ে দিতেন। এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যেত আধ্যাত্মিক সাধনায়। তাকে সবাই ডাকত বুড়া হুজুর নামে। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর এটি ‘বুড়া মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আরেকটি সূত্রে জানা যায়, শ্রীপুর এলাকায় তৎকালীন দুই বুজুর্গ ব্যক্তি রয়েছে। যাদের নাম হযরত আনছার উল্লাহ শাহ (র.) ও হযরত কুদরত গণি শাহ (র.)। তারা অনেক প্রাচীন কালের বুজুর্গ ব্যক্তি। এলাকায় তাদেরকে বুড়া হুজুর বলেই ডাক নাম আছে। অনেকের ধারণা তাদের নামেই বুড়া মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে।