ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে লাগা আগুন ২৭ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নিভেছে। গতকাল রোববার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেনটেইন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, শনিবার আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা একে একে ৩৭টা ইউনিট এখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। আমরা ৪টা ৫৫ মিনিটে (রোববার) এটা সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করেছি।
তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছিল, প্রতিটা জায়গাতেই আসলে খোপ খোপ করে ভাগ করা ছিল এবং ভেতরে অনেকগুলো অংশ স্টিলের তৈরি। স্টিলের স্ট্রাকচার দিয়ে একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত আছে; যেটার জন্য আমাদের আগুন নেভাতে এত সময় লেগেছে। তার ভাষ্য, এখানে যদি অ্যাকটিভ অথবা প্যাসিভ মানে আমাদের যে–কোনো ধরনের ডিটেকশন সিস্টেম যদি থাকত এবং তার সাথে প্রোটেকশন সিস্টেম থাকত, তাহলে হয়তো এতটা দুর্ঘটনা ঘটত না। আমাদেরও তদন্ত করে বের করতে হবে আসলে কখন কীভাবে এই আগুনটা ধরে। খবর বিডিনিউজ, বাংলানিউজ ও বাসসের।
ঘটনাস্থলে এখনো ধোঁয়া ওড়ার বিষয়ে করা এক প্রশ্নের উত্তরে তাজুল বলেন, যেহেতু এখানে স্টিল স্ট্রাকচারের ইস্যুটা অনেক বেশি, এটা অনেক হিট অ্যাবজর্ভ করেছে এবং হিট এখনো রিলিজ করছে। হিট যেহেতু রিলিজ করছে, তার সাথে তার অথবা অন্যান্য কিছু কমবাসেবল ম্যাটেরিয়াল রয়ে গেছে, এজন্য ধোঁয়া কিছুটা দেখতে পাচ্ছেন। তবে ভয়ের কোনো কারণ নাই, কোনো আগুনের শিখা নাই। আর যদি হয়ও, তাহলে আমাদের চারটা ইউনিট এখানে অবস্থান করবে যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধোঁয়াগুলো থাকবে। বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নাই বিধায় আমরা নির্বাপণ ঘোষণা করছি।
শনিবার দুপুরে শাহজালালের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, পুলিশ, আনসার, র্যাব, এপিবিএন, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাত ৯টার কিছু পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। আগুনে বিভিন্ন ধরনের আমদানি করা মালামাল পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার প্রেক্ষাপটে সাময়িক সময়ের জন্য যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের এলাকা দিয়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজ।
আগুন নেভাতে কেন দীর্ঘ সময় লাগল : অগ্নি নির্বাপণ করতে দীর্ঘ সময় লাগার পেছনে একাধিক কারণ তুলে ধরেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা। ব্রিফিংয়ে এই দীর্ঘসূত্রতার প্রধান কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী। আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগার প্রধান কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ৫টি বিষয় উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য বস্তু (কমবাসেবল ম্যাটেরিয়াল) বেশি থাকা, স্টিল স্ট্রাকচারের কারণে তাপ শোষণ, অপরিষ্কার ও গাদাগাদি পরিবেশ, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এবং ছোট ছোট স্টিলের স্ট্রাকচার কেটে ভেতরে প্রবেশের জটিলতা।
তাজুল ইসলাম বলেন, কার্গো ভিলেজের ভেতরের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত ঘন এবং সরু, যেখানে ছোট ছোট কম্পার্টমেন্ট বা ঘরের মতো ভাগ ছিল। এর ফলে ফায়ার ফাইটারদের জন্য ভেতরে প্রবেশ ও আগুন নেভানোর কাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কনফাইনড স্পেস এবং প্রচুর কমবাসেবল ম্যাটেরিয়ালের কারণে আমরা ফায়ার হুক দিয়ে ধীরে ধীরে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছি।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কার্গো ভিলেজে কোনো সক্রিয় (ফায়ার অ্যালার্ম, ডিটেকশন সিস্টেম) বা প্যাসিভ (স্বয়ংক্রিয় প্রটেকশন সিস্টেম বা স্প্রিংকলার) অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ছোট ছোট ভাগে ভাগ থাকায় স্টিলের স্ট্রাকচার কেটে ফায়ার ফাইটারদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে, যা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টসাধ্য। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের দুজন এবং আনসার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। বড় ধরনের কোনো সিগনিফিকেন্ট দুর্ঘটনার খবর নেই।
তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, এত বেশি তাপমাত্রায় থাকার কারণে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ফাটল দেখা গেছে, কলামেও ফাটল রয়েছে। ভবন কর্তৃপক্ষকে জরিপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভেতরে থাকা ওষুধ ও বিভিন্ন বাই–প্রোডাক্ট থেকে কেমিক্যাল এজেন্ট তৈরি হওয়ায় কিছুটা পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও মিরপুরের কেমিক্যাল গোডাউনের মতো তেজস্ক্রিয়তা বা বড় ধরনের প্রভাব নেই।
অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি : শাহজালালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারীকে। অন্য সদস্যরা হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব মুঃ রইচ উদ্দিন খান ও মোঃ তারেক হাসান এবং ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মুহাম্মদ কামরুল হাসান। কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব পঙ্কজ বড়ুয়া। কমিটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেবে।
পণ্য খালাস চলছে বিকল্প উপায়ে : কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার প্রেক্ষাপটে সাময়িক সময়ের জন্য যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের এলাকা দিয়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। পণ্যের কায়িক পরীক্ষা ও শুল্কায়নের জন্য নয় নম্বর ফটকে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড অটোমেশন সিস্টেমের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জনসংযোগ দপ্তর বলেছে, আপাতত যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের (জিএসই বা গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স) স্থান দিয়ে পণ্য খালাস প্রক্রিয়া চালু করেছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এখানে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করছেন। ৯ নম্বর ফটকে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সংযোগ স্থাপনও করা হয়েছে।