আমার খালাতো ভাই আবদুল মমিন ভাই তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। সেখানে অনেক বাঙালি আর্মি ছিলেন। তারা প্রত্যক্ষ করেন যে পাঞ্জাবীরা তাদেরকে দমন করার চেষ্টা করছে এবং করেও ফেলেছে। এছাড়া বাঙালি ছাত্র যুবককে তারা মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। প্রতিটি সময় মমিন ভাইয়েরা আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। এ সময় সুযোগ করে মমিন ভাই কুমিল্লা শহরে আমাদের বাসায় আসলেন। মাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার মেঝভাই নুরুল আমিন ও ছোট ভাই রুহুল আমিন কোথায়। মা বললেন তারা এখন বাসায় নেই। তিনি বললেন খালা আমার সময় খুবই কম। আমি রিক্স নিয়ে এসেছি। আমি এখনি ফিরে যাবো। আপনি যেভাবেই হোক নুরুল আমিন ও রুহুল আমিনকে দ্রুত গ্রামের বাড়ি অথবা অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিন। ওরা যে কোনো সময় ওদেরকে ধরে নেবে। তিনি সতর্ক করে দ্রুত জীপ নিয়ে ক্যান্টমেন্টে চলে গেলেন। এই যে ছিলো উনার শেষ যাওয়া –কে জানতো।
এদিকে মমিন ভাইয়ের অন্য দুইভাইও পাকিস্তানে আটকা পড়েন। আমার বড় খালা তখন ছেলেদের শোকে পাগল প্রায়। খালা ছেলের জন্য বুক চাপরাইয়ে বিলাপ করে কান্না করতেন বলতেন, মমিনরে কেমনে মায়ের বুক খালি করে চলে গেলি বাবা, আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো। আর বলতেন, হে খোদা তুমি আমার বড় ছেলেকে নিয়ে গেলে, বাকী দুই ছেলেকে বাঁচাইয়ে রেখো। আমার বড় খালা আমেনার চিৎকার করে কান্নায় আমাদের আশে পাশের মানুষ চলে আসতো এবং তারাও ব্যথিত হয়ে নীরব কান্নায় ভেঙে পড়তো। আমার অসুস্থ মা মমিন ভাইয়ের চিন্তায় খুবই আহত হয়ে পড়েন। সাথে সাথে নুরুল আমিন ভাই ও মুক্তিযোদ্ধা ছেলে রুহুল আমিন ভাইয়ের চিন্তায় চিন্তিত থাকেন। এভাবেই কাটছিলো মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো। নানা আশা–ভরসা, দুশ্চিন্তা, হতাশার ভিতর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়।
অবশেষে এলো সেইদিন কিন্তু বুঝতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন ভাই লুকিয়ে এসে বাসায় ঘুমাচ্ছেন। আমি সকালের দিকে উঠানের এক সাইডে হাউজের পাশে আমাদের বাসার টিউব ওয়েলের কলে চাউল ধুচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে এলো ‘জয় বাংলা’। সাথে সাথে মনে হলো গতকাল রাতভর যে গোলাগুলি শুনেছিলাম সেটাতো তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানীরা যুদ্ধ হয়েছিলো এবং সেই যুদ্ধে তাহলে পাক আর্মি হেরে গেছে। না হলেতো জয় বাংলা শ্লোগান দেয়ার কথা না। সাথে উৎসুখ মন ভরে উঠলো এবং তাৎক্ষণিক দৌড়ে যেয়ে খবরটা আমি নুরুল আমিন ভাই ও রুহুল আমিন ভাইকে দিলাম। সাথে সাথে আমার দু’ভাই গগন বিদারী ‘জয় বাংলা’ চিৎকার দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পিছনে আমাদের কোনো কথা শুনার চেষ্টা করেনি। এদিকে বাবা, মা ও আমরা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি পাছে কোন অজানা বিপদের চিন্তা করে। যদি পাকিস্তানী আর্মিরা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর থেকে ভারী মটরগান ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণ করে তাহলে সবাই মারা পড়বে। সারাদিন অপেক্ষার পরে দেখি অনেক গভীর রাতে আমার ভাইয়েরা ফিরে আসে। রাস্তা ঘাট পথ প্রান্তর এবং মহল্লার বিভিন্ন বাসা–বাড়ি থেকে শুধু আনন্দ ধ্বনি ও জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হচ্ছে।
অতঃপর ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় কুমিল্লা জেলা। জেলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ের ধ্বনি। উত্তোলিত হয় লাল–সবুজের পতাকা। মুক্তির স্বাদ পাওয়া হাজার হাজার মানুষের জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো কুমিল্লা।