প্রায় ৮ বছর ধরে আলোচনায় থাকা নগরের ২১টি খাল এবার পুনরুদ্ধার হবে? শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা এই ২১টি খালের উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২০২৩ সালে একটি কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। গত বছর ওই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে থমকে যায় প্রকল্পের কাজ। এর এক বছর পর খালগুলো পুনরুদ্ধারে নতুন করে উদ্যোগ নেয় চসিক। এবার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) এবং প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করতে ‘পাওয়ার চায়না’র সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে চীনের প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার রেন হাও–এর সাথে বৈঠকও করেছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল পাওয়ার চায়না’র এর সাথে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণে চসিকের একটি সমাঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়। এর প্রেক্ষিতে চীনের প্রতিষ্ঠানটি ১ বছর ধরে নগরের বিভিন্ন খাল ও নালা–নর্দমার উপর জরিপ কাজ চালায়। সর্বশেষ, ২০১৭ সালের ২৩ এপ্রিল তৎকালীন মেয়রের হাতে প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট তুলে দেয়। এ স্টাডি করতে পাওয়ার চায়নার খরচ হয় ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘ফ্ল্যাড কন্ট্রোল অ্যান্ড ওয়াটার লগিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ‘জি টু জি’ (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া গৃহীত সিডিএ’র মেগাপ্রকল্প। ফলে বাদ পড়ে চসিকের প্রকল্পটি। দীর্ঘ ৯ বছর পর ২১ খাল নিয়ে চসিকের প্রকল্পে আবারও সম্পৃক্ত হচ্ছে এই পাওয়ার চায়না।
এদিকে গতকাল সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পাওয়ার চায়না’র কান্ট্রি ম্যানেজার রেন হাও ২১টি খাল নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নে আগ্রহ দেখিয়েছেন। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে পূর্বের ন্যায় আবারও ‘জি টু জি’ (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী পাওয়ার চায়না।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। পাওয়ার চায়না ২১টি খাল নিয়ে জি টু জি পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। তারা সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের মেয়াদকালে একবার স্টাডি করে, তাই তাদের অভিজ্ঞতা আছে। তারপরও তাদের নতুন করে ২১টি খাল নিয়ে স্টাডি করতে বলি। স্টাডি শেষে তারা ডিপিপি প্রস্তুত করবে। ২১টি খাল পুনরুদ্ধার করা গেলে শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আবার জি টু জি পদ্ধতিতে প্রকল্প হলে আমাদেরও কোনো অর্থ খরচ হবে না।
এক নজরে ২১ খাল : ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান–২০১৬ অনুযায়ী, মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ খাল হচ্ছে– চট্টেশ্বরী খাল, ১৫ নং ঘাট এয়ারর্পোট খাল, রামপুর খাল, বালুখালী খাল, কৃষ্ণখালী খাল, কুয়াইশ খাল, ফরেস্ট খাল, উত্তর সলিমপুরের বারিঙ্গাছাড়া খাল এবং ভাটিয়ারির ধামাইর খাল। এছাড়া নেভাল একাডেমি, চরপাড়া, হোসাইন আহমেদ পাড়া, সিইপিজেড আনন্দবাজার, সিইপিজেড নতুন পাড়া, উত্তর হালিশহর, উত্তর কাট্টলী, লতিপফুর এবং সলিমপুরের স্লইস গেইটের ১১ টি সংযুক্ত খালও রয়েছে।
কনসালটেন্ট ফার্মের অস্বীকৃতি : চসিকের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২১টি খালের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগে ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করে চসিক। এতে ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর এক বছর পর ওয়াশো ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকে নিয়োগ দেয়া হয়। ৩৪ লাখ টাকায় নিয়োগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের শুরুতে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা সিইজিআইএসও কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
কথা ছিল, নির্বাচিত কনসালটেন্ট ফার্ম নতুন করে জরিপ করে খাল সনাক্ত করবে। আরএস–বিএস শীট এর আলোকে খালের সীমানা নির্ধারণ করবে। খালের উপর থাকা অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এর পরিমাণও নির্ণয় করবে। খালের পাড়ে রাস্তা নির্মাণে কি পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে এবং এর মূল্য নির্ধারণ করবে। খালের পাড়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে প্রাথমিক নকশা এবং এর ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করবে। পানির প্রবাহ, ঝড় এবং অন্যান্য আবহাওয়া সংক্রান্ত ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রকল্পের প্রাক সম্ভাব্যতাও যাচাই করবে প্রতিষ্ঠানটি।
২১ খালের গুরুত্ব : চট্টগ্রাম ওয়াসার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান–২০১৬ অনুসারে নগরে খাল আছে ৫৭ টি। খালগুলোর দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এদিকে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হচ্ছে ৩৬ খালের। যার দৈর্ঘ্য ৯৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ২১ টি খাল প্রকল্পের বাইরে রয়ে গেছে। তাছাড়া ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে নগরের ৫৭ খাল থেকে ১৪ লক্ষ ঘন মিটার কাদা ও মাটি উত্তোলনের প্রস্তাবনা রয়েছে। বিপরীতে সিডিএ’র গৃহীত প্রকল্পে ৯ লক্ষ ৪৮ হাজার ২১৪ ঘন মিটার কাদা ও মাটি উত্তোলনের প্রস্তাবনা আছে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় সিডিএ’র মেগা প্রকল্পে মাটি উত্তোলনের পরিমাণ কম থাকায় প্রশ্ন উঠে মেগা প্রকল্পের সুফল নিয়ে এবং প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ২১ খাল নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নের। অর্থাৎ ৮ বছর আগে ২১ খাল নিয়ে প্রকল্প প্রণয়নে আলোচনা শুরু হয়। যা সম্প্রতি আরো জোরালো হয়।
পরবর্তীতে ২০২২ সালের ৫ ফেব্রয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত কার্যক্রমের পর্যালোচনা সভায় ২১ খাল নিয়ে চসিকের প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।