প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ডিম ছেড়েছে। ২০২০ সালের পর এবার সবচেয়ে বেশি ডিম ছেড়েছে। এবার ১৮ থেকে ২০ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে তার তুলনায় হ্যাচারি ও কুয়া পর্যাপ্ত নয়, তাই অনেকে ডিম সংগ্রহ না করে চলে গেছেন। গত শনিবার সকাল থেকে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণ শুরু হলে নদীতে ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওইদিন বিকাল থেকে কার্পজাতীয় মা মাছ নদীর রামদাস মুন্সির হাট, মাছুয়াঘোনা, আমতুয়া ও নয়াহাট এলাকায় নমুনা ডিম ছাড়ে। গত রোববার সকাল থেকে জোয়ার ও ভাটার সময় সকালে বিকালে পুনরায় ডিমের নমুনা ছাড়ে। বছরের শেষ অমাবস্যা জো’তে রোববার দিবাগত রাতে আমতুয়া আজিমারঘাট, নাপিতেরঘাট, মাছুয়াঘোনা খারিরমুখ, কুমারখালি ও পোড়াকপালির স্লুইচ গেইট মাছুয়াঘোনা, কাগতিয়ারটেক, সিপাহিরঘাট, পাতাইজ্জ্যার টেক, গড়দুয়ারা নয়াহাট, চেংখালী সুইস গেইট এলাকায় পুরাদমে মা মাছ ডিম ছাড়ে। রোববার রাত থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ডিম ছাড়া অব্যাহত ছিল। ডিম ছাড়ার পরিমাণ থেকে ডিম থেকে রেণু উৎপাদনের হ্যাচারি ও মাটির কুয়ার পরিমাণ কম থাকায় অনেক ডিম সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ না করে নদী থেকে উঠে আসে।
২০২০ সালের পর এবার মা মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছেড়েছে বলে সংগ্রহকারী ও হালদা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ২০২০ সালে হালদা নদীতে ২শ ৮০টি নৌকায় ২৫ হাজার ৫শ ৩৬ কেজি ডিম ছাড়ে মা মাছ। ২০২১ সালে প্রায় ৩শ ৬০ জন ডিম আহরণকারী ২শ ৮০টি নৌকায় ৮ হাজার ৫শ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন। ২০২২ সালে প্রায় ৯শ জন ডিম আহরণকারী ৩শ নৌকায় মাত্র ৬শ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন। বিগত ৫/৭ বছরের মধ্যে ওটা ছিল সবচেয়ে কম ডিম।
গত রোববার দিবাগত রাতে সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে মা মাছ। এবার ৩শ নৌকায় প্রায় সাড়ে ৯শ ডিম সংগ্রহকারী ১৮–২০ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে সরকারের নির্ধারিত কমিটি আগামী শুত্রুবার যৌথ সভা করে সংগৃহীত ডিমের প্রকৃত হিসাব নির্ধারণ করবে বলে জানান হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া। সরকার নির্ধারিত সংস্থাগুলো হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, কৃষি বিদ্যালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তর। ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য চারটি সরকারি হ্যাচারি, একটি বেসরকারি হ্যাচারি এবং কিছু মাটির কুয়া রয়েছে। কিন্ত এবার যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে তার তুলনায় এই হ্যাচারি ও কুয়া পর্যাপ্ত নয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নিদের্শনা অনুসারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, নৌ পুলিশের তৎপরতা, হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও মিঠা পানির ডলফিন রক্ষায় নানামুখী কার্যক্রম এবং নদী দূষণের ব্যাপার অভিযান অব্যাহত ছিল। নদী থেকে মাছ চুরির ঘটনা সনাক্ত করতে মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া পর্যন্ত ৮টি পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
এবার তাপদাহ ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রকোপের কারণ হালদা নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর পরও মা মাছ নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম ছেড়েছে বলে উল্লেখ করেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।
মাদার্শা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া জানান, গত বছরের তুলনায় এবার ডিমের পরিমাণ অনেক বেশি। তাকে আহরিত ডিমের পোনা রেণু ফোটানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তার চারটি নৌকায় ১৫–১৬ বালতি ডিম পেয়েছে বলে জানান তিনি।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের (সিসিপিসি) জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম জানান, রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নদীর বিভিন্ন অংশে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। রাতের জোয়ারের নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম ছেড়েছে মা মাছ। সোমবার সকালেও ডিম আহরণ অব্যাহত ছিল।
অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, নদীর আমতুয়া, আজিমার ঘাট, নাপিতেরঘাটে প্রচুর পরিমাণ ডিম পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, জোয়ারের সময় নদীর উপরিভাগেও ডিম ছেড়েছে। এখন হালদার পাড়ে প্রতীক্ষিত ডিম থেকে রেণু ফোটানোর উৎসব চলছে। ডিম আহরণকারীরা এই মুহূর্তে ডিম থেকে রেণু ফোটাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম বলেন, গত বছরের তুলনায় ডিমের পরিমাণ বেশি। নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ার পর দুর্বল হয়ে পড়ে। কেউ যাতে মা মাছ শিকার করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সংগ্রহকারীদের মুখে হাসি : রাউজান প্রতিনিধি জানান, এবার মৎস্যজীবীরা কাঙ্ক্ষিত ডিম সংগ্রহ করেছেন। প্রত্যাশিত ডিম সংগ্রহ করতে পেরে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে।
রাউজান উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা পিযুষ প্রভাকর জানান, অনেকে আগেভাগে সংগ্রহ করা ডিম নিয়ে হ্যাচারিতে গেছেন।
জানা যায়, রাউজান ও হাটহাজারীতে মৎস্য বিভাগের তিনটি হ্যাচারিতে ডিম থেকে পোনায় রূপান্তরের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে রাউজানের মোবারকখীল হ্যাচারিতে ডিম আনা হয়েছে এক হাজার ১৭০ কেজি বেং হাটহাজারীর মদুনাঘাট হ্যাচারিতে এক হাজার ৬৭০ কেজি। এই উপজেলার শাহামাদারী হ্যাচারিতে কী পরিমাণ ডিম নেয়া হয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হ্যাচারি ছাড়াও অনেক সংগ্রহকারী মাটির কুয়ায় ডিম রেখে পোনা উৎপাদন করেন। নদীর দুই পাড়ে এই ধরনের কুয়ার সংখ্যা ৬৮টি। এর বাইরে বেসরকারি একটি সংস্থা কর্তৃক ইট–সিমেন্ট নির্মিত কুয়া রয়েছে ৩০টি।