দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) আরও নতুন ৬টি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ছয়টি জাহাজ কেনার পর নতুন করে আবারো ছয়টি জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। এর বাইরে কন্টেনার জাহাজ কেনারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটে থাকা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির বহরে অন্তত ২০টি জাহাজ যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বিএসসি। নতুন ৬টি জাহাজ কেনার বিষয়টি নিয়ে একাধিক কমিটি কাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের শিপিং সেক্টরের ক্রমবিকাশ হলেও রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিএসসিকে বহুমুখী সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। দীর্ঘদিনের পুরানো সব লক্কর ঝক্কর মার্কা জাহাজগুলো লোকসান দিয়ে চালাতে হচ্ছিল সংস্থাকে। আশির দশকে বিএসসিতে ৪৪টি জাহাজ থাকার রেকর্ড থাকলেও ক্রমান্বয়ে প্রায় সব জাহাজ স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করা হয়। কেবলমাত্র দুইটি জাহাজ নিয়ে টিকে ছিল বিএসসি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ৩টি বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ২০১৯ সালে তিনটি প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার কেনার পর বিএসসির বহরে বর্তমানে জাহাজের সংখ্যা ৮টি।
এর মধ্যে একটি জাহাজ ইউক্রেনে গিয়ে আটকা পড়েছে। এই জাহাজটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যুদ্ধ বন্ধ হলে জাহাজটিকে এনে মেরামতযোগ্য হলে মেরামত করে পরিচালনা করা হবে। আর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে পুরো ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে।
উক্ত ৮টি জাহাজের পাশাপাশি নতুন আরো ৬টি জাহাজ কেনার ব্যাপারে বর্তমানে বিএসসি দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করছে। ইতোমধ্যে জাহাজ কেনার ব্যাপারটি বোর্ড অনুমোদনও দিয়েছে। নতুন ৬টি জাহাজের মধ্যে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি মাদার ট্যাংকার, ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার ও ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার। এই ৬টি জাহাজ কেনা হলে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪টিতে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বিএসসির যে পরিমান লোকবল এবং অবকাঠামো রয়েছে তাতে অনায়াসে ২০টি জাহাজের একটি বহর পরিচালনা করতে পারে। বর্তমানে বিএসসির সক্ষমতার অনেকটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এই অবস্থায় বিএসসি অন্তত ২০টি জাহাজের একটি বহর গড়ে তুলতে চায়। অপরদিকে বিশ্বব্যাপী কন্টেনার পরিবহন ব্যবসার জয়জয়কার চললেও বিএসসির বহরে কোন কন্টেনার ভ্যাসেল নেই। এই অবস্থায় বিএসসি নিজেদের বহরে দুইটি কন্টেনার ভ্যাসেলও যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
গতকাল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিএসরি বহর প্রায় জাহাজশূন্য হয়ে পড়েছিল। ৬টি জাহাজ কেনার পর কিছুটা গতি পেয়েছে। এর মধ্যে একটি জাহাজের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কিছুটা শংকার মধ্যে রয়েছি। বিএসসির জন্য আমরা নতুন করে আরও ৬টি জাহাজ কেনার কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, আমাদের জ্বালানি তেল পরিবহন করে কোটি কোটি ডলার বিদেশি জাহাজ মালিকেরা নিয়ে যাচ্ছে। বিপিসির জন্য আমদানিকৃত ক্রুড ও পরিশোধিত তেল পরিবহন করতে পারলেও দেশের অনেক বড় উপকার হয়। কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। লাভবান হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিএসসিও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা বলেন, নতুন ৬টি জাহাজের মধ্যে ১ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার ২টি ক্রুড ওয়েল মাদার ট্যাংকার কেনার চিন্তাভাবনা করছি আমরা। তিনি ইস্টার্ন রিফাইনারী দ্বিতীয় ইউনিট চালুসহ দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, বর্তমানে দেশে ৬৫ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। যা পুরোপুরি জাহাজের মাধ্যমে আনা হয়। ইস্টার্ন রিফাইনারীর দুইটি ইউনিট পুরোদমে চালু হলে ত্রিশ লাখ টনের মতো ক্রুড অয়েল পরিশোধন করতে পারবে। ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুইটি মাদার ট্যাংকার থাকলে ইস্টার্ন রিফাইনারীর প্রয়োজনীয় ক্রুড অয়েলের পুরোটাই বিএসসি পরিবহন করতে পারবে।
এছাড়া বিপিসি বছরে প্রায় ৩৫ লক্ষ টন ডিজেল অয়েল ও প্রায় ৩ লক্ষ টন জেট ফুয়েল পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করে। ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার দুইটি প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার কেনা হলে এই তেলের একটি বড় অংশ নিজেদের জাহাজে পরিবহন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে বাস্তবায়নাধীন তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য প্রচুর কয়লা আমদানি করতে হবে। এই কয়লা আমদানির ব্যাপারটি নিরবিচ্ছিন্ন এবং নির্বিঘ্ন রাখতে নিজেদের জাহাজের বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় কয়লা পরিবহনের জন্য ৮০ হাজার টনের ২টি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ দেশের বাইরে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহউদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দুইটি মাদার ট্যাংকারসহ ৬টি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি এখন নেগোশিয়েন পর্যায়ে রয়েছে। আমরা চীনের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলছি। জাহাজগুলো কেনার ক্ষেত্রে বড় কোন প্রতিবন্ধকতা নেই বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আলাপ আলোচনা এগুচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলেই জাহাজ কেনার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।