ঋণের টাকা উদ্ধারে নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা রাস্তায় নেমেছেন। চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন চট্টগ্রামের ২০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা। যাদের কাছে ঋণ বাবদ সুদ–আসল মিলিয়ে ব্যাংকটি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ব্যাংকটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে এসব শিল্পপতির অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে সামাজিকভাবে যাতে তারা অসম্মানের মুখোমুখি হন, সেজন্য ব্যতিক্রমী এ কর্মসূচি পালন করতে তারা বাধ্য হয়েছেন।
গতকাল সোমবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি, চট্টগ্রাম সার্কেলের ব্যানারে শ’খানেক কর্মকর্তা–কর্মচারী অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন। তারা চট্টগ্রাম সার্কেলের অধীন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তা–কর্মচারী বলে জানান। বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা ব্যানার নিয়ে তারা মানববন্ধনে হাজির হন।
মানববন্ধনে ব্যবহৃত বিশালাকৃতির ব্যানারে চট্টগ্রামের ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দুজন শিল্পপতির নাম উল্লেখ ছিল। যাদেরকে ঋণখেলাপি এবং ব্যাংকের টাকা ঋণ দেওয়া প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতি বলে অভিযোগ করেন মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।
ব্যানারে নাম লেখা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে সাদ মুসা ফেব্রিক্স লিমিটেড (ইউনিট–১ ও ২), মেসার্স জয়নাব ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ মাহমুদ, মেসার্স ম্যাক শীপ বিল্ডার্স, যার চেয়ারম্যান মো. আলা উদ্দীন, সিএসএস করপোরেশন (বিডি) লিমিটেড, ইন্ট্রাকো সিএনজি লিমিটেড, সামানাজ সুপার অয়েল, স্টার সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেসার্স আরাফাত স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স মিসম্যাক শীপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স, মেসার্স এফএন্ডএফ শীপ রিসাইক্লিং, মেসার্স মাহী ফিস প্রসেসিং লিমিটেড, এম রহমান ভিটা, এপিটি ফ্যাশন, শফিক স্টিল, রুবাইয়া ভেজিটেবল, মেসার্স স্টিল কন্সেপশন সী ফুড লিমিটেড, মেসার্স বাংলাদেশ ইলেকট্রিসিটি মিটার কোম্পানি লিমিটেড, দোভাষ শিপিং লাইনস এবং মেসার্স হাসান এন্টারপ্রাইজ।
অগ্রণী ব্যাংক চট্টগ্রাম সার্কেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল হক সাংবাদিকদের জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ৪০০ কোটি টাকার অধিকাংশ কৃষিঋণ, যা চট্টগ্রাম জেলা ও তিন পার্বত্য জেলায় বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। আমরা ব্যাংকের স্টাফরা অসহায় ছিলাম। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজন উপর মহলে তদবির করে, অনেক সময় আমাদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু যে ২০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা প্রকাশ করেছি, তারা সঠিক সময়ে ঋণগুলো ফেরত না দেওয়ায় এখন পর্যন্ত পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৪৭০ কোটি টাকা।
আনোয়ারুল হক বলেন, এদের সুদ এবং আসল মিলে ঋণের পরিমাণ আরো বেশি। আমরা রিশিডিউল করে দেড় হাজার কোটি টাকার মতো নথিপত্র থেকে বাদ দিয়ে বাকি টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু সেটাও তারা দিচ্ছে না। শুনেছি, ঋণ পরিশোধ না করে অনেকে কানাডায় গিয়ে বাড়িঘর করে সেখানে বসবাস করছে। এদিকে ঋণের টাকা আদায় করতে না পেরে আমাদের নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমরা তো নিজেদের প্রয়োজনে তাদের ডেকে এনে ঋণ দিইনি, দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
ঋণ আদায়ে অবস্থান কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারুল হক বলেন, আমরা বারবার তাগাদা দিয়েছি, মামলা করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে আর কী করতে পারি? সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ঋণ আদায়ের কৌশল হিসেবে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি। তারা যাতে সামাজিকভাবে হেয় হন, তাদের মধ্যে যেন বোধোদয় হয়, ব্যাংকের টাকাগুলো জনগণের টাকা, এগুলো ফেরত দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, এসব লোকজন ব্যাংকের টাকা মেরে ফুটানি দেখায়, পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে ঘোরেন। লোকজন দেখে ভাবে, ও মারে! অনেক বড় শিল্পপতি। আবার এলাকায় গিয়ে দান–খয়রাতও করেন। মানুষের কাছে দানবীর সাজেন। অথচ বছরের পর বছর ধরে তারা ব্যাংকের টাকাগুলো পরিশোধ করছেন না, একেকজনের যে পরিমাণ লোন, পাল্লায় তুলে দশবার মাপলেও সেটার সমান হবে না।