২০২৪ অনেক ঘটনা বহুল বছর। ছাত্র জনতার অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আশা আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় তখন মানুষের মনে আশা জাগতে শুরু করে। আন্দোলন যতই তীব্র হয় মানুষের আশা ততো বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ আন্দোলনের অংশ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীর দাবি দাওয়ার সাথে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা একাকার হয়ে যায়। তখন এ আন্দোলন হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য গণ আন্দোলন। যার অনিবার্য পরিনতি স্বৈর শাসনের অবসান। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রশস্তকরণ।
২০২৫ সাল কেমন যাবে তা বলা সহজ নয়। তবে ২০২৫ সাল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর হবে। দীর্ঘদিনের পুরানো জঞ্জাল সরানো অত্যন্ত কঠিন কাজ। অনেক প্রতিবন্ধককতা আছে যা সরাতে গেলে হাজার জঞ্জাল বেরিয়ে আসে। শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলার পথকে আটকে দিতে চায়। চলার গতিকে এমনভাবে রুদ্ধ করে দেয় বেরিয়ে আসতে পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরানো ব্যবস্থায় চলতে চলতে অনেকে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যে কোন ধরনের পরিবর্তনকে সহজে মেনে নিতে পারে না। যদিওবা সবাই জঞ্জাল সরিয়ে নতুন ব্যবস্থা চায় অর্থাৎ সংস্কার চায়। এমন একটি ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পরিবর্তন করতে হবে না। কারণ আগের ধাঁচে বা পুরানো নিয়মে চলতে গেলে মানুষের মাঝে যে আশা জেগেছে তা কখনো পূরণ হবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ এত বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে যা আবার আশাহত করে তুলতে পারে। এজন্য ২০২৫ সালের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। আশার সাথে সম্ভাবনা বা প্রাপ্তির সংযোগ না হলে আবার ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে।
আগের সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভের সীমা নেই। অনেক বিষয়ের মধ্যে দুটি ব্যাপারে মানুষের ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। একটা হলো দ্রব্যমূল্য, লাগামহীন দ্রব্য মূল্য, অসহনীয় দ্রব্য মূল্য। দ্রব্য মূল্যের কষাঘাত দেশের সব মানুষের ওপর গিয়ে পড়ে। ধনী দরিদ্র সবাই এর শিকার হয়। লাগামহীন দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে যায়। যে কোন দ্রব্য ক্রয়ে দরিদ্রদের নাগালের বাইরে চলে যায়। কখনো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ফিরে আসে না। বাজার সিন্ডিকেটের কবলে থেকে যায়। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা প্রয়োজনমত বাজার সওদা করতে পারে না। এ অবস্থার উত্তরণও হয় না। আরেকটা হলো মানুষ ভোট দিতে না পারা। ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না দেয়া। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পেরে ফিরে আসা। বছরের পর বছর দীর্ঘ সময় ভোট দিতে না পারায় মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ভোটের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা দেখা দেয়। যার কারণে পরবর্তীতে মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি থাকে না। অনেকটা ভোটার বিহীন ভোট হয়ে যায়।
তরুণেরা ভোট দিতে না পারার বিষয়টি কোন মতে মেনে নিতে পারে না। তাদের অনেকে ভোটার হওয়ার পর দুই তিনবার সংসদ নির্বাচন হয়েছে। তারা কিন্তু একবারও ভোট দিতে পারেনি। সাধারণ ভোটার যারা তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে না। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগে ভোট হয়ে যায়। দিনের ভোট রাতে হয়ে যায়। বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হয়ে যায়। ভোটের কোন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানুষের ভেতর ক্ষোভ থেকে যায়। নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার ক্ষোভ। ভোটাধিকারকে মানুষ অনেক বড় অধিকার মনে করে। এ অধিকারটা যখন থাকে না তখন মানুষ অন্য অবলম্বন খোঁজে। সুযোগ গেলে প্রতিবাদ করে। ভোট দিতে না পারার কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরে। যা আগের সরকারকে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করে তোলে। সরকার শত চেষ্টা করেও তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মানুষ সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এদেশের রাষ্ট্র কাঠামো থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন সবকিছু আগের সরকারের আমলে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কোন প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে কাজ করে না। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। আর্থিক খাত চরম বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত। ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্যের শেষ নেই। গার্মেন্টস সেক্টরে গতি ফিরে আসেনি। শিল্প খাতে উৎপাদনও নানা কারণে ব্যহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবায় চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা খাতে অনিশ্চয়তা কাটেনি। শিক্ষার্থীরা পুরাপুরিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখী হতে পারেনি। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মনোনিবেশ আগের মতো নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম অব্যস্থাপনা একইসাথে দূর্নীতির চক্র সক্রিয়। অন্যান্য খাতেও দুর্বৃর্ত্তের চক্র বিরাজমান। কোন একটি সেবা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় না। সরকারি আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কোথাও ভোগান্তি ছাড়া কোন কাজ হয় না। নির্র্দিষ্ট ফি এর বাড়তি দিয়েও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। সর্বত্র এরকম অবস্থা বিরাজ করে। মানুষ এসবের শেষ চায়, এখান থেকে বের হতে চায়।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনস্বার্থে কাজ করার নিমিত্তে কার্যকর করে গড়ে তোলার জন্য সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান আগের মতোই নিয়ন্ত্রণহীন লাগামহীনভাবে অনিয়ম করে যাবে। দূর্নীতি ছাড়া কোন কাজ হবে না। পদ্ধতি বা সিস্টেমের সংস্কার করতে হবে। একইসাথে মানসিকতারও সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে সংস্কারকে তারা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবে। এখন সব ক্ষেত্রে সংস্কার করতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। সংস্কার আবার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সবাই পরিবর্তন বা সংস্কার চাইলেও অনির্দিষ্ট কালের জন্য কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন এবং আর্থিক খাতের সংস্কার সবার আগে প্রয়োজন। যে কোন মূল্যে আর্থিক খাত বা ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। এ খাতের ওপর দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নির্ভরশীল এবং এখাতের সাথে আরো অনেক খাত জড়িত। আর্থিক খাতের উন্নতি ঘটাতে পারলে ব্যবসা বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থা গতিশীল হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
বর্তমান সময়ে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা মানুষের দীর্ঘদিনের। এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার যেখানে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারে। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। নিজের ভোট নিজে দিতে পারে। এর চেয়ে মানুষ আর বেশি কিছু চায় না। এজন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। যে কমিশন প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একইসাথে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকেও। এক্ষেত্রে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। সংস্কার ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই অনেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এ বছর নির্বাচন চায়। এক পক্ষীয় নির্বাচন কেউ চায় না। সবাই চায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। যে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিবে। ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিবে। ভোটের মাধ্যমে জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে। যে নির্বাচিত হবে অন্যরাও তাকে গ্রহণ করে নেবে। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে যত সহজে বলে দেয়া যায় বাস্তব ক্ষেত্রটা কিছুটা ভিন্ন। আন্দোলনের তরুণ সমন্বয়কেরা জন আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কিভাবে চায় তাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দাবি দাওয়া, নির্বাচন ও সংষ্কারে তাদের মতামতের প্রতিফলন এ বছরের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সংস্কার ও নির্বাচন কার্যক্রম একসাথে চলবে। তবে নির্বাচন কখন হবে তার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না হলেও সবাই ধরে নিয়েছে এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠু নির্বাচন। যাতে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষর প্রতিফলন ঘটবে। এজন্য ২০২৫ সাল জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী