স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা কিরূপ ছিল তা বর্তমান জেনারেশন উপলব্ধি করতে না পারলেও বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেন (যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) ব্যক্তিরা খুব ভালোই উপলব্ধি করতে পারে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি ও আমার পরিবার ভারতে যাইনি বলে এদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যথাযথ অনুধাবন করতে পেরেছি। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল রাউজান থানায় ১৪নং বাগোয়ান ইউনিয়নে যা কাপ্তাই রোড সংলগ্ন গশ্চি গ্রামে। বাড়ির পূর্বপাশে এক মাইল দূরবর্তীতে ছিল নয়াহাট নামে একটি বাজার। আর পশ্চিম পাশে আধামাইল দূরে ছিল ব্রাহ্মণহাট নামে আর একটি বাজার। গ্রামের বাজারগুলোতে সাধারণত সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে। যতটুকু মনে পড়ে, নয়াহাট বাজারটিতে হাট বসত শনিবার ও মঙ্গলবার। আর ব্রাহ্মণহাটের বাজারটিতে হাট বসত সোমবার ও বৃহস্পতিবার। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিবারের জন্য বাজার করার দায়িত্ব ছিল আমার। যেহেতু আমি বাজার করার মত কনিষ্ঠ সন্তান সেহেতু মা আমাকে বাজারে পাঠাতো এক টাকা দিয়ে। এই এক টাকা দিয়ে আলু, মূলা, কপি ও অন্যান্য তরকারি এবং সর্বশেষে সকালের চা তৈরির জন্য আধা কেজি গুড় ও আনতে হতো।
আমার এখনো মনে পড়ে যে, এক টাকা দিয়ে তিন সের এবং চার সের পর্যন্ত ইরি চাউল পাওয়া যেত। তবে সেই সময়ে মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। ফলে ক্রয় ক্ষমতা ছিল সীমিত। এখনো মনে পড়ে, রান্নার জন্য অধিকাংশ সময় সরিষার তৈল ব্যবহার করা হতো। আমাদের গ্রামে এমন কোনো পরিবার ছিল না যেই পরিবার ১ সের (এখন লিটার বলা হয়) সরিষার তৈল কেনার ক্ষমতা রাখে। ফলে সপ্তাহের এই দুই দিনে হাটে যাবার সময় দুইটি ছোট বোতল অধিকাংশ লোক নিয়ে যেত। এদের একটি হচ্ছে সরিষার তৈল আনার জন্য। আর অপরটি হচ্ছে কেরোসিন তৈল আনার জন্য। কারণ তখনও গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ আসেনি। ফলে প্রতিটি পরিবারে রাতে হারিকেন বা বাতি জ্বালানোর জন্য কেরোসিন ছিল অতি প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। বাজারের চারিপাশের গ্রাম থেকে লোক বাজারে কেনাকাটার জন্য আসত। কিন্তু গ্রামের কাকেও ১ সের সরিষার তৈল বা ১ সের কেরোসিন বা ১ সের চিনি বা গুড় অথবা ১ সের সাবান কিনতে দেখিনি। তখনও ৩৭ সাবান ছিল জনপ্রিয় সাবান। আর গ্রামের অতি ধনী ব্যক্তিরা কালেভাদ্রে একটি গায়ের সাবান কিনত। তা হলো লাক্স বা কসকো সাবান। অধিকাংশ পরিবার ৩৭ সাবান কিনত সর্বোচ্চ ১ পোয়া। আর আমাদের মত দরিদ্র পরিবার কিন্তুু আধা পোয়া সাবান। চিনির তুলনায় গুড় ব্যবহার করতো বেশি। তবুও গ্রামে ধনী পরিবারগুলো কদাচিৎ চিনি ক্রয় করতো। তাও আবার ১ পোয়া (২৫০ গ্রাম) এর বেশি নয়। এরূপ স্বল্প চাহিদার কারণ কী? বলা যায়, ক্রয় ক্ষমতার স্বল্পতা। আজ ২০২৫ সালে এসে জেন-জি এর কাছে প্রশ্ন রাখতে বড়ই ইচ্ছা করে- এ অবস্থা কি কল্পনা করা যায়? আজ তোমরা যাদেরকে সিনিয়র সিটিজেন বলে বুড়ো বলছো- এঁরা তাঁরাই, যাঁরা বাংলাদেশে সেই প্রাথমিক অবস্থা কাঠিয়ে তোমাদেরকে মানুষ তথা শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এদেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা তথা মাথাপিছু আয়কে বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ এখনো উন্নত দেশের স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি উন্নয়নশীল দেশের কক্ষেও প্রবেশ করতে পারেনি। তবুও এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় যেমন বেড়েছে তেমনি ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। এখন মানুষ আর আধা পোয়া সাবান ক্রয় করে না। এক ছটাক চিনি ক্রয় করে না, বিক্রেতাও এত স্বল্প পরিমাণ সাবান, চিনি বিক্রয় করতে চায় না। তা কিভাবে সম্ভব হলো? এরূপ ক্রয় ক্ষমতার বৃদ্ধি একদিনে হয়নি। ক্রমাগত অর্থনীতির সব খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে অর্থনীতি পরিচালনা করে আজকে এই বাংলাদেশের অবস্থান। বিগত সময়ের প্রবৃদ্ধির কথা বাদ দিলেও ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অগ্রগতি ও অর্জন কতটুকু হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু কিছু খাত ছাড়া অন্যান্য খাতে অগ্রগতির ধারা এখনো বজায় আছে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত) বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ( Gross Domestic Product ) প্রবৃদ্ধির পরিমাণ হয় ৩.৯৭ শতাংশ। অবশ্য এইখাতে প্রবৃদ্ধি পূর্বের তুলণায় হ্রাস পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪.২২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫.৭৮ শতাংশ আর ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ৭.১০ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি একটি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.১৮ শতাংশ যা পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় অধিক। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ছিল ৯.৭৩ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এই দেশের অর্থনীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে অর্থনীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল বেশি। অবশ্য এখানে মে’২৫ পর্যন্ত নেয়া ১১ মাসের হিসাব দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণকে যদি তুলনা করা হয় তবে ২৬ জুন’২৫ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০.৫১ বিলিয়ন ডলার। অথচ ৩০ জুন’২৪ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ২৬.৭১ বিলিয়ন ডলার। ৩০ জুন’২৩ এবং ৩০ জুন’২২ সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে- ৩১.১৪ ও ৪২.৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালে রিজার্ভের পরিমাণ ২০২৫ সালের তুলনায় বেশি ছিল। তাছাড়া ২০২৫ সালের জুনে বেশি রিজার্ভের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, এটি খুব ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু আমদানি খরচ কম হওয়া এবং বিদেশি ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, এটা বলা যাবে না। তবে যে পরিমাণ রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে তার অন্যতম কারণ হলো বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং রপ্তানী আয় বৃদ্ধি। একদিকে আমদানি কমেছে অন্যদিকে জুন’২৫ এর শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF ), বিশ্বব্যাংক (IBRD ) ও এশীয়া উন্নয়ন ব্যাংক (ADB ) এর কাছ থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের মতো, অর্থঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব কারণে রিজার্ভ বেড়েছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও এতে ভূমিকা রেখেছে অধিক। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলার সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বৈধ পথে প্রবাসী আয় এসেছে ৩ হাজার ৩৩ কোটি ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে পণ্য রপ্তানি আয় ও ভূমিকা রেখেছে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মে মাস পর্যন্ত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলার। অবশ্য ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এর তুলনায় রপ্তানি আয় বেশি ছিল। রাজস্ব আদায়ের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সাময়িক হিসাবে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩ লক্ষ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। অথচ ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ছিল ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১ কোটি টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল। তবে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পূর্বের তুলনায় অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বচরে যেখানে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ ডলার সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এই আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এতটুকু এগিয়েছে তা অনেকাংশে বৃহৎ অর্জন বলা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।