অর্থনীতি কোন ব্যক্তি নয়। অর্থনীতি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া বা নিয়ম যা বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে উন্নয়নের কৌশলগুলো জানা যায়। তবে অর্থনীতির প্রক্রিয়া বা তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ হয় সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের মাধ্যমে। আবার প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব সত্তা রয়েছে। অতএব অর্থনীতির কৌশল প্রয়োগে যদি নিজ নিজ স্বত্ত্বার প্রয়োগ ঘটে, তবে অর্থনীতির তত্ত্ব যথাযথ কাজ করতে পারে না। ফলে ঘটে বিপত্তি। এ কারণে অর্থনীতি বিষয়টিকে বলা হয় সামাজিক বিজ্ঞান। যদি মনে করা হয় যে, উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির তত্ত্বগুলোকে যথাযথ ব্যবহার করা হবে তবে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থনীতির উন্নয়ন হতে বাধ্য।
দ্রুত গতিতে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা তথা ব্যক্তির কৌশলিক জ্ঞানের পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে অর্থনীতির নীতিগত প্রয়োগও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার কারণে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের সুফল জনগণ ভোগ করছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আবার সরকার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সময়ের দায়িত্ব অতি জটিল। বিগত বছর সমূহের তুলনায় সরকারকে অধিকতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে এ চ্যালেঞ্জগুলো কি কি? এ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার, জ্বালানী খাতের নিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতে সংস্কার, ঋণ খেলাপী কমানো, বেনামী ঋণ বন্ধ করা ,বিনিয়োগ নীতি সংস্কার করা, কর আদায় বৃদ্ধি করা, দুর্নীতি সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা, বিদেশে পুঁজি পাচার বন্ধ করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব বন্ধ করা ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ২০২৩ সালের শুরুতেই মূল্যস্ফীতি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। শাক–সবজি থেকে আরম্ভ করে সকল প্রকার নিত্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির হয়ত তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির অবস্থা খুবই খারাপ। অধিকাংশ নিম্নবিত্ত শ্রেণি শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি সঞ্চয় ভেঙ্গে ভেঙ্গে জীবন যাত্রা নির্বাহ করছে। কাজেই নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি দমন করা বা কমিয়ে আনা। কোন কোন সময় সরকার মূল্যস্ফীতির জন্য মজুতদার ব্যবসায়ীদেরকে দায়ী করেছেন। এ কথা সত্য যে, এসব মজুতদার ও মুনাফা খোর ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন দলের লোক বলে নিজদের পরিচয় দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। অবশ্য ইতিমধ্যে শাহেদ, সাবরীনা নামক দুই জনের কাহিনী থেকে আমরা জানতে পেরেছি। শেষ মুহুর্তে তারাও রেহায় পায়নি। এ রকম হাজার এমনকি লক্ষাধিক ব্যবসায়ী বা লোক আছে যারা নিজদেরকে ক্ষমতাসীন লোক বলে পরিচয় দিয়ে পণ্য মজুত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। পণ্য মূল্য বৃদ্ধির ইহা একটি প্রধান কারণ। মূল্যস্ফীতি হ্রাস করার জন্য সরকারকে এরূপ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে।
জ্বালানী সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকারকে শক্ত হাতে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডলার সংকটের মূল কারণ হলো জ্বালানি খাতে ব্যয়। ২০২২–২৩ অর্থ বছরে ৮২০ কোটি ডলারের এল.এন.জি আমদানি করেছে সরকার। যদি নিজস্ব গ্যাস থাকতো তবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এল.এন.জি আমদানি করতে হতো না। এখন ডলার দিয়ে এল.এন.জি কিনে সরকারকে টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে বিশাল অংকের ডলার ব্যয়িত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে ডলার সংকট– ইহা একটি বড় কারণ। অন্যদিকে কল–কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এর ফলে গ্যাস নির্ভর কারখানাগুলোর উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। আর উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে রপ্তানি পরিমাণও কমে যাচ্ছে। ফলে ডলার আয়ের উৎসও কমে গেছে। সরকারকে এ বিষয়টি শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে হবে। সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলারের (এক লাখ কোটি ডলার) অর্থনীতিতে নিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। পরিকল্পনা করছে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করার। কিন্তু উৎপাদনের চাকা ঘুরানোর জন্য যদি কারখানায় গ্যাস পাওয়া না যায়, তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। আবার আমদানি নির্ভর গ্যাস দিয়েও কলকারখানা চালালে তাতে প্রচুর পরিমাণ ডলার ব্যয়িত হয়ে যায়। অতএব আমাদেরকে গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগ দিতে হবে। আমদানি নির্ভর জ্বালানি দিয়ে শিল্প নির্ভর টেকসই উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সূচকগুলো অনেকদিন স্থিতিশীল ছিল। ফলে কোভিড মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। তখন অর্থনীতি এমন অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়েনি। পরবর্তীতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, বর্তমানে লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণে–বাণিজ্যকে করেছে অস্থিতিশীল। বিশ্বের খাদ্য ভাণ্ডার ইউক্রেন থেকে খাদ্য আমদানি বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য পণ্যের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে খাদ্যের সাথে জড়িত অন্যান্য বিষয়গুলো ও বিশ্বের পণ্যমূল্যকে করেছে অশান্ত। আর বর্তমানে হুতিদের আক্রমণে লোহিত সাগরের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সকল রপ্তানিমুখী জাহাজকে অনেক দূরের পথ অতিক্রম করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে হয়। এতে পরিবহন ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে মূল্যস্ফীতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবে কিনা সন্দেহ।
আবার কিছু কিছু মূল্যস্ফীতি আছে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। এগুলোকে বহিরাগত মূল্যস্ফীতি বলা যায়। যেমন– বিগত বছলগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সুদের হার বার বার বাড়িয়েছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি করেছে সেহেতু সমগ্র বিশ্ব থেকে ডলার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী। এর ফলে ডলারের দাম বেড়েছে। আর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করার কারণে পণ্যমূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরণের মূল্যস্ফীতি সরকারের নাগালের বাহিরে।
আবার হুন্ডি ব্যবসাও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও সরকার এদেশের হুন্ডি ব্যবসায়ীদের থামাতে পারছে না। এখনও পর্যন্ত প্রবাসী আয়ের ৫২ শতাংশ হুন্ডিতে আসে। এ অর্থ বছরে এখনো পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে। যদি হুন্ডি বন্ধ করা সম্ভব হতো তবে এ আয় হতো ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর একটা চ্যালেঞ্জ হলো খেলাপী ঋণ। খেলাপী ঋণকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। প্রথমটি হলো, বেনামি ঋণ। আর দ্বিতীয়টি হলো মন্দ ঋণ। হল মার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি বেনামি ঋণ উদ্ধারে সক্রিয় হতে হবে। অর্থনীতির প্রথাগত নিয়মে বেনামি ঋণের দায়ভার অবশ্যই ব্যাংকারদের ওপর পড়ে। ব্যাংকারদের যুক্তি হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ গ্রহণ করা হয় বলে তারা ঋণ দিতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে উদ্যোক্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সাথে জড়িত থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপীকে ধরতে আইন করতে হবে। আজ থেকে ১৪ বছর আগে ভারতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের ধরতে আইন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো করা সম্ভব হয়নি। খেলাপী ঋণ উদ্ধার করা এবং মন্দ ঋণ বিতরণ না করার জন্য সরকারকে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এটা বর্তমান সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে কোটিপতি ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে এবং এখনও বাড়ছে। অথচ করোনার কারণে এদেশে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়েছে। শহরাঞ্চলে বস্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরূপ প্রবণতাকে অবশ্যই হ্রাস করতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে দিন দিন কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়লেও কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে না। কর আদায় না বাড়ায় অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন কার্যক্রম, প্রকল্প বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। দেশে কোটিপতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কোটিপতিরা ১–২ কোটি টাকার সম্পদের মালিক নয়। ১০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু সেই হারে কর আদায় বাড়ছে না। কর আদায়ের হার বাড়ানো নতুন সরকারের নিকট বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কোটিপতিরা তেমন কর দিতে চায় না।
সরকারের কাছে আরো বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং খাতের ১০–১৫ টি ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সরকার এসব দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। সরকারকে শক্ত হাতে এসব চ্যালেঞ্চ মোকাবেলা করতে হবে। অতীত থেকে বলা যায়, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সমস্যা নিজ হাতে মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে প্রবেশ করতে পারবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি