আশা–নিরাশা–প্রত্যাশা–প্রাপ্তির জাগতিক রসায়নে বছর যায় বছর আসে। দেশ–জাতি–প্রতিষ্ঠান–ব্যক্তিসহ সকল স্তরের জনজীবনে পুরাতন বছরের রেখাপাত নতুন বছরের জন্য নবতর সম্ভাবনা তৈরি করে। মানুষ মাত্রই সহজ–সরল বিশ্বাসের বশীভূত। স্বপ্নের বিলাসী বিভোরতায় জীবনের অনেক সময় কেটে যায় বাস্তব–অবাস্তবের দোলাচলে। তবুও জীবন থেমে না থাকার সত্যকে ধারণ করেই এগিয়ে চলার মানসিক পট নির্মাণ স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়া। ২০২৪ সাল অতিক্রান্ত হতেই অতীত–নিকট অতীতের অনেক ইতি–নেতিবাচক স্মৃতি মনকে আড়ষ্ট করবেই। পুরোবিশ্ব ২০২৪ ইংরেজি বর্ষকে বিদায় জানিয়ে ২০২৫কে বরণ করার অপেক্ষায় রয়েছে। আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক–কূটনৈতিক ইত্যাদিকে ঘিরে ২০২৪ সাল ছিল ঘটনাবহুল বছর। উন্নয়ন–অনুন্নয়নের নানামুখী অখ্যানে আশার সঞ্চারের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে নিরাশার আর্তনাদকে করেছে দীর্ঘশ্বাসে ভরপুর। পৃথিবী নামক এই গ্রহের প্রায় প্রত্যেক প্রান্তেই সমাধানের চেয়ে সমস্যার বিস্তার ঘটেছে বহুগুণ বেশি।
রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তন, যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা–গণহত্যার নির্মম কাতরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্দয় দৃশ্যাদৃশ্য অনভিপ্রেত প্রেক্ষাপট তৈরিতে ছিল তৎপর। সচেতন মানবসমাজ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শুধু ভুলুন্ঠিত হতেই দেখেছে। গণতন্ত্রের মোড়কে সর্বগ্রাসী দমন–পীড়ন–নিপীড়ন–নির্যাতনের দৃশ্যপট স্থান–কালভেদে কুৎসিত রূপ পরিগ্রহ করেছে। ক্ষমতার বলয় প্রসারে কর্তৃত্ববাদী দেশ ও সরকার সর্বনিকৃষ্ট পন্থায় জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। বহুদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণ নাগরিক সমাজের মুক্তচিন্তার অবাধ বিচরণকে করেছে সংকুচিত। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভূ–রাজনীতির পরিসর অভিশপ্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিরোধ–বিচ্ছেদ–প্রতিহিংসা–প্রতিশোধ প্রায়ই সত্য–সুন্দরকে করেছে কলুষিত। ২০২৪ সালে পৃথিবী জুড়ে নির্বাচনের নামে অরাজকতা–কারচুপি–সংঘর্ষ–সংঘাতের বর্ধিষ্ণু অপসংস্কৃতিই শুধু পরিলক্ষিত হয়েছে।
বছরব্যাপী বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৩৭০ কোটি মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়েছে বিধায় জাতিসংঘ ২০২৪ সালকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর হিসেবে অবহিত করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত দ্য আইডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ‘দ্য ২০২৪ গ্লোবাল ইলেকশন্স সুপার–সাইকেল’ লাইভ প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে ইতিমধ্যে বিশ্বের ৭৪টি দেশের মধ্যে ৭৩টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল ৫টি দেশের নির্বাচন। অনেক দেশে পূর্বের নেতৃত্ব ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। আবার অনেক দেশের জনগণ নিজেদের জন্য নতুন নেতৃত্ব বেছে নিয়েছে। মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যের ভোটাররা নতুন নেতা নির্ধারণ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র শাসন করছেন।
বৈশ্বিক রাজনীতির অতীব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণ করে পুরোবিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৩০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে তিনি প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার রায় ও নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়কালে তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টাসহ নানামুখী কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল নিবদ্ধ। তাছাড়া ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৬৩টি দেশের নির্বাচনের মধ্যে ১৩ শতাংশ নির্বাচন বিরোধীপক্ষ কর্তৃক প্রত্যাখিত হয়েছে এবং ১৫ শতাংশ নির্বাচনে পরাজিত দল বা প্রার্থী প্রকাশ্যে ফলাফল প্রত্যাখান করেছে। ২৮ শতাংশ নির্বাচনের পর বিক্ষোভ হয়েছে ও ২০ শতাংশ নির্বাচনে সহিংসতার শিকার হয়ে বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করলেও প্রধান বিরোধী দল তা বর্জন করে। অধিকন্তু বিশ্বের অনেক দেশ–সরকারের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য ছিলনা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২৪ সালে বিভিন্ন দেশের সরকারসমূহের কদর্য অগণতান্ত্রিক–অমানবিক কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে নাগরিক অসন্তোষের সূত্রপাত হয়। পুরো বিশ্বে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে অপসংস্কৃতির পরিচর্যায় বিরোধ–বিচ্ছেদ–সহিংসতাসহ রাজনৈতিক অপরাধ ও অপরিসীম জনদুর্ভোগে প্রায় বিপর্যস্ত। গণমাধ্যমে দমন–পীড়নের কারণে ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি ও ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলোতে প্রচন্ড বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কর্মসূচি–পাল্টা কর্মসূচির প্রভাবে আপামর জনসাধারণের জীবন প্রবাহ হয়ে পড়ে প্রচন্ড বাধাগ্রস্ত। দাবি আদায়ের নামে কতিপয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন সভা–সমাবেশ সহনশীল পরিবেশে আবদ্ধ না থেকে নানামুখী আক্রমণ–সংঘাত–অগ্নি সংযোগ–হত্যা অমানবিক অপত্যৎপরতায় ছিল পর্যুদস্ত। অনেক দেশে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সোচ্চারের বিষয়টি ছিল সমধিক আলোচ্য। দুর্নীতির কারণে ক্ষুদ্ধ হয়ে আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ কোরিয়া এবং উগান্ডায় বিক্ষোভ হয়। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে আলবেনিয়া, বলিভিয়া, ভারত, পাকিস্থান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে রাজনৈতিক সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করে।
বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারীর দুঃসহ স্মৃতি মুছে যাওয়ার আগেই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে হত্যা–গণহত্যার মতো নির্মম–নির্দয়–অমানবিক দৃশ্যাদৃশ্য বৈরী অভিপ্রায় নির্মাণে এখনও অতিশয় সচল। খাদ্য–জ্বালানিসহ নানামুখী বিপর্যস্ততা একদিকে বিশ্বব্যবস্থাকে লন্ডভন্ড করে চলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি এবং সংস্কারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রদর্শন দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা ছিল কেনিয়া এবং নাইজেরিয়ায়। দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিক্ষোভ সরকারের বৈধতার জন্য বৃহৎ চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছিল। পেনশন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় বরাদ্ধ, শ্রম আইন, আবাসন ও পর্যটন নীতির বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, আর্জেন্টিনা, বলম্বিয়া, ফিনল্যন্ড, ভারত, পতুৃগাল এবং স্পেনে গণমানুষের প্রতিবাদ চলমান রয়েছে।
প্রাসঙ্গিকতায় বিশ্বকবি রবীঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট’ লেখনির উদ্বৃতি উপস্থাপন করতে চাই– ‘অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধহয় পৃথিবীর আধুনিক শাসন–চালিত কোনো দেশেই ঘটেনি। অথচ এই দেশে ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুৃগিয়ে এসেছে। যখন সভ্য জগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে নিবিষ্ট ছিলেন তখন কোনোদিন সভ্যনামধারী মানব–আদর্শের এতো বড়ো নিকৃষ্ঠ বিকৃত রূপ কল্পনাই করতে পারিনি; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম ঔদাসীন্য।’ একইভাবে বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরের আর্থ–সামাজিক চালচিত্র জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রতিফলিত নয়। বাজার ব্যবস্থার চরম অসঙ্গতি, ব্যাংকখাতে ঋণ জালিয়াতি, অর্থপাচার, বেপরোয়া দুর্নীতি, বিরোধী শক্তির কন্ঠরোধ, গুম, খুন, ইত্যাদির ভয়াবহতা জনগণের উপলব্ধিকে ভয়ানক আঘাত করে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ক্রমাগত গণরোষে পরিণত হয়ে ছাত্র–জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আশ্রিত হয়।
ফলশ্রুতিতে জুলাই ২৪ গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। গঠিত হয় বিশ্ববরেণ্য শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। গণতান্ত্রিক–অসাম্প্রদায়িক–ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় দেশের আপামর জনগণ। অতীতের সকল অপাংক্তেয়–অযৌক্তিক–অগ্রহণযোগ্য বিষয়সমূহকে সংহার করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য নানামুখী সংষ্কারের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যৌক্তিক সংস্কার সম্পন্নের পর রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক অবাধ–নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। জনগণ আশা করছে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নতুনরূপে অভিষিক্ত হবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকার বিশ্বপরিমন্ডলে ইতোমধ্যেই সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। বিশ্বইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায়ে পরিপূর্ণ প্রতিস্থাপিত হতে বাংলাদেশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সফল ও সার্থক হয়েছে।
আশাকরি ২০২৫ সাল সকল অশুভ শক্তির হিংস্র পশুতুল্য আচরণকে সংহার করে বাংলাদেশসহ বিশ্ব মানবিকতা–অসাম্প্রদায়িকতা–যুদ্ধাংদেহী মনোভাব নির্মূলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বৈশ্বিক সৌহার্দ–সম্প্রীতি–ভালোবাসা–শ্রদ্ধা–পারস্পরিক প্রীতির সম্মিলনে ধরিত্রী নতুন অবগাহনে উদ্ভাসিত হবে। সর্বোপরি দেশের দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি–মূল্যস্ফীতি–দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ লাঘবে বিদ্যমান সকল সঙ্কট চিহ্নিত ও পরিত্রাণের উপায় নির্ধারণ, দ্রুততম সময়ে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সন্ত্রাস–দুর্নীতি–অনিময় দূরীকরণে সকল প্রতিষ্ঠানের আত্মশুদ্ধিকরণ, ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রীদের সকল অপকৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে যথার্থ অর্থেই দেশ এগিয়ে যাবে। পরিশুদ্ধ কর্মপন্থা অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে নতুন বছরের ইতিবাচক সকল উদ্যোগকে অধিকতর উদ্যমী ও নির্ভীক রূপ পরিগ্রহে সময়োপযোগী সহায়ক করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী