গেল ২০২৩ সালে দেশে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৩৭২ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল গতকাল রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর–রুনি মিলনায়তনে এই হিসাব তুলে ধরেছে।
সমিতির হিসাবে, গত বছর সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ৯২৯ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ৫০৫ জন, আহত হয়েছেন ১০ হাজার ৯৯৯ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা সড়কে মোট মৃত্যুর ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। সারা বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত বছর রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন, নৌপথে ১৪৮ দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ১০৯ জন। এছাড়া গত বছর যত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত নয় বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি–হুইলার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে দুর্ঘটনার শিকার ৮ হাজার ৫৫০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বাস, ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ট্রাক–পিকাপ–কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ কার–জিপ–মাইক্রোবাস, ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ অটোরিকশা, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ নছিমন–করিমন–মাহিন্দ্রা–ট্র্যাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর মোট দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ১ দশমিক ১১ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে, শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।
ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ২৩৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২০৫ জন, খুলনা বিভাগে ৭৬৫ সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৩৮১ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১৮ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন, সিলেট বিভাগে ৩৭১ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৩ জন, রংপুর বিভাগে ৫৬৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬ জন ও রাজশাহী বিভাগে ৭৮৮ সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৯৩ জনের প্রাণ গেছে।
দুর্ঘটনার কারণ : বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক অভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, যানবাহন চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার উপর হাট–বাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালানো, চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকাকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সুপারিশ : দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ১. সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার প্রকল্পে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা। ২. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা। ৩. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট শক্তিশালী করা। ৪. দেশের সড়ক–মহাসড়কে রোড সাইন, ট্রাফিক চিহ্ন স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা। ৫. চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ৬. অনিয়ম–দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা; গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি আধুনিকায়ন করা। ৭. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিলে আবেদনের সময়সীমা ৬ মাস নির্ধারণ করা। ৮. দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া। ৯. ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা। ১০. মহাসড়কের রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উঁচু করা।