১৯ বছর ধরে বর্ণমালা শেখানোর লড়াই

১১ হাজার মানুষকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন ইনজেব ও তার সংগঠনের প্রশিক্ষকেরা

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

মাতৃভাষার বর্ণমালা শেখানোর জন্য গত ১৯ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন ইনজেব চাকমা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নিভৃতপল্লী পূর্ব কাঠালতলী গ্রামের তরুণ ইনজেব পেশায় কৃষক। ব্যক্তি জীবনে আর্থিক টানাপোড়ন থাকলেও চাকমা জনগোষ্ঠীকে বর্ণমালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তিনি। ইতোমধ্যে ১১ হাজারের বেশি মানুষকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন ইনজেব ও তার সংগঠনের প্রশিক্ষকেরা। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটি ও বান্দরবানে বসবাসরত চাকমা জাতিগোষ্ঠীকে চাকমা বর্ণমালা শেখানো হয়।

সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৮৩ হাজার। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটি ও বান্দরবানে এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাহাড়ের বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা ‘অঝাপাত’। তার লিখিত রূপের চর্চা নেই বললেই চলে। চাকমা ভাষায় কথা বললেও বর্ণমালা না জানায় লিখতে পারে না চাকমা জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ।

বিভিন্ন স্কুলকলেজে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ বর্ণমালা শিখতে আগ্রহী হচ্ছে। শুক্রবার দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজে বর্ণমালা ক্লাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। এ সময় চাকমা বর্ণমালা শিখতে আসা জেকি চাকমা ও হিতৈষী চাকমা বলেন, জাতিতে চাকমা হলেও আমাদের নিজস্ব ভাষা ঠিকমতো বলতে পারি না। আমাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ভাষার বর্ণমালা শেখা দরকার। এখনো চাকমা বর্ণমালা চিনি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। ব্যর্থতা দূর করার জন্যই বর্ণমালা শিখছি।

ইনজেবের নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ থেকে বর্ণমালা শিখে এখন নিজেই শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন কয়েকজন প্রশিক্ষক। তাদের একজন রিমি চাকমা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের বসবাস। আমাদের বর্ণমালা ‘অঝাপাত’ আছে। বলতে পারলেও আমরা তা লিখতে পারি না। আমরা নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ থেকে বর্ণমালা শিখেছি। এখন নিজেই স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীদের তা শেখাচ্ছি। এখন অনেকেই চাকমা বর্ণমালা লিখতে পারে।

তিন পার্বত্য জেলায় ২শ ১৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ১শ ১৮ জনকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন ইনজেব চাকমা ও তার সংগঠন। এছাড়া ৪১টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

ইনজেব চাকমা বলেন, চাকমা ভাষা সমৃদ্ধ। বর্ণমালা থাকার পরও তার লিখিত রূপের চর্চা না থাকার কারণে তা হারিয়ে যাচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে আমরা মাতৃভাষায় কার্যক্রম শুরু করেছি। সরকার মাতৃভাষায় প্রাথমিকের বই দিয়েছে। কিন্ত মাতৃভাষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় শ্রেণী পাঠদান করাতে পারছেন না। ইতোমধ্যে আমরা প্রাথমিকের শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা এখন বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আমার লক্ষ্য, ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো চাকমা জাতিগোষ্ঠীকে নিজস্ব বর্ণমালার সাথে পরিচয় করানো। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, হেডম্যান, কার্বারী ও চেয়ারম্যানদের চাকমা বর্ণমালা শেখানো হয়।

ভাষা রক্ষায় এমন উদ্যোগ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি অর্থায়নে নিজস্ব মাতৃভাষায় কবিতা, ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা ও বই প্রকাশের উপর জোর দিয়েছেন খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক জিতেন চাকমা। তিনি বলেন, ইনজেব চাকমা নিজ উদ্যোগে বর্ণমালা শেখাচ্ছেন। বর্ণমালার চর্চা বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে আমরা ইনস্টিটিউট থেকে চাকমা, ককবরক ভাষায় বই প্রকাশ করেছি। তবে সরকারিভাবে এই উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউৎসবমুখর পরিবেশে শিশুদের খাওয়ানো হলো ভিটামিন এ ক্যাপসুল
পরবর্তী নিবন্ধপাঁচলাইশ থানার ওসিসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা