১৫ বছর পর শুরু হচ্ছে ‘নতুন কুঁড়ি’ : একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পুনঃসূচনা

মামুনুর রশিদ শিপন | শনিবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক নাম, ‘নতুন কুঁড়ি’। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে প্রথম শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা আজও অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে। দেশের কিশোরকিশোরীদের প্রতিভা বিকাশের জন্য এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় পদক্ষেপ, যা বহু প্রজন্মকে শিল্পের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে।

১৫ বছর পর, এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানটি আবার শুরু হতে যাচ্ছে, একটি নতুন আঙ্গিকে। আগামী অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ‘নতুন কুঁড়ি’এর প্রাথমিক বাছাই পর্ব।

নতুন কুঁড়ি’ শুধু একটি শিশুকিশোর প্রতিযোগিতা ছিল না, বরং এটি ছিল সাংস্কৃতিক বিকাশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের টেলিভিশন (বিটিভি) শুরু করে একটি বৃহৎ উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিভা এক প্ল্যাটফর্মে উঠে আসার সুযোগ পায়।

১৫ বছর পর আবার এই প্ল্যাটফর্মটি খুলে যাচ্ছে এবং এতে নতুন প্রজন্মের প্রতিভা বিকাশের এক সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক জীবনে একটি বড় পরিবর্তন আনবে।

স্বাধীনতার মহান ঘোষক, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংস্কৃতিক দর্শন ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রকৃতপক্ষে একটি উদ্যোগ, যা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। তাঁর লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবও চালু করা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচুর প্রতিভা লুকিয়ে আছে, যা সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুযোগ পেলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য অর্জন করতে পারে।

শহীদ জিয়া মনে করতেন যে, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে ‘নতুন কুঁড়ি’ একটি জাতীয় মঞ্চে পরিণত হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা গান, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি, বাদ্যযন্ত্র, চিত্রাঙ্কন সহ নানা ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারত। এটি ছিল শিশুদের জন্য শুধুমাত্র একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং একটি শিক্ষা ক্ষেত্রও, যেখানে তারা শিখত এবং নিজেদের প্রতিভাকে আরও বিকশিত করার সুযোগ পেত।

শিল্পীদের প্রথম মঞ্চ ‘নতুন কুঁড়ি’: ‘নতুন কুঁড়ি’ শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, এটি ছিল দেশের সাংস্কৃতিক শিল্পীদের প্রথম মঞ্চ। আজ যাঁরা আমাদের সিনেমা, সংগীত, নৃত্য বা নাটকে জনপ্রিয়, তাঁরা অনেকেই তাঁদের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘নতুন কুঁড়ি’র মাধ্যমে। এটি ছিল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বহু প্রতিভাবান শিল্পীকে দেশের প্রধান মঞ্চে তুলে এনেছিল। এই প্রতিযোগিতা শিল্পীদের জন্য ছিল এক নতুন জীবন, যেখানে তারা নিজেদের মেধা ও দক্ষতা প্রমাণ করার সুযোগ পেত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, স্কুলগামী শিশুরা, এমনকি গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষও তাদের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পেত, যা তাদেরকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করে তুলত। এটি ছিল এমন এক প্রতিযোগিতা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা শুধু প্রতিযোগিতাই করত না, বরং সাংস্কৃতিক শিক্ষাও লাভ করত। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে, অনেক অজানা শিল্পী শিখেছিল কীভাবে শৃঙ্খলা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় দিয়ে একে একে শিল্পের শীর্ষে পৌঁছানো যায়। এভাবে, বাংলাদেশে বহু জনপ্রিয় গায়ক, অভিনেতা, উপস্থাপক এবং নৃত্যশিল্পী তাঁদের পথচলা শুরু করেছিলেন।

নতুন কুঁড়ি’ জাতির সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রতীক:‘নতুন কুঁড়ি’ ছিল এবং এখনও একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক। এটি দেখিয়ে দিয়েছিল যে, দেশে এমন এক অসীম সম্ভাবনা রয়েছে, যা যদি সঠিক সুযোগ ও প্ল্যাটফর্ম পায়, তবে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য লাভ করতে পারে। যে সকল শিল্পীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

বাংলাদেশের বিনোদন ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এ অনুষ্ঠানের ভূমিকা ছিল অনন্য। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পীদের পরিচিতি দিয়েছিল, যা তাঁদের পরবর্তী জীবনের ক্যারিয়ার গড়তে সহায়ক হয়েছিল। বহু গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী এবং উপস্থাপক, যাদের আজ আমরা জনপ্রিয় চেহারা হিসেবে জানি, তাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই মঞ্চ থেকেই।

বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি নতুন সুযোগ: আজ থেকে পনেরো বছর পর, ‘নতুন কুঁড়ি’ আবার ফিরে আসছে। বর্তমানে আমরা একটি নতুন প্রজন্মের মুখোমুখি, যারা ডিজিটাল যুগে বড় হচ্ছে। এই নতুন প্রজন্মের প্রতিভা আবিষ্কারের জন্য ‘নতুন কুঁড়ি’ আবারও সামনে আসছে। এটি শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং একটি শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে, যেখানে প্রতিভাবান শিশুকিশোররা নিজেদের শিল্পকলা প্রদর্শনের সুযোগ পাবে এবং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন এক যাত্রা শুরু করতে পারবে।

প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, আজকের শিশুরা শুধু তাদের প্রতিভাকে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে না, বরং সেই প্রতিভাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতাও লাভ করবে। এর মাধ্যমে অনেক শিশুই পেশাদার শিল্পী হওয়ার জন্য এক নতুন দিকনির্দেশনা পাবে। এছাড়া, ‘নতুন কুঁড়ি’ আগামী দিনের সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে, যা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিনিয়োগের প্রতি জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করবে।

নতুন কুঁড়ি: একটি সাংস্কৃতিক বিনিয়োগের ধারকবাহক: অবশেষে, ‘নতুন কুঁড়ি’ একটি সাংস্কৃতিক বিনিয়োগের ধারকবাহক হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হবে। এটি শুধুমাত্র প্রতিভার প্রদর্শন নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক রুচি, শিল্পচর্চার শৃঙ্খলা এবং দেশপ্রেমের চেতনা সৃষ্টি করবে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী দৃষ্টি এবং এই সাংস্কৃতিক উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রযোজনায় মান ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা আজও সমাদৃত। এবার, পনেরো বছরের বিরতির পর, ‘নতুন কুঁড়ি’ আবারও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এক নতুন অধ্যায় শুরু করবে।

লেখক: সদস্য সচিব, চট্টগ্রাম মহানগর জাসাস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে