১৫ বছরের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে মা-বাবার নামে ফয়সল ইউনুসের স্বপ্নযাত্রা ‘আহমদ সুফিয়া’ দাতব্য চিকিৎসালয় 

সাতকানিয়ায় গরিবদের স্বাস্থ‍্যসেবার ঠিকানা

সাতকানিয়া প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

ছাত্রজীবন থেকে ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে মানুষের সেবার জন্য কিছু করার। ইচ্ছে থাকলে তো হবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে যেখানে নিজের শিক্ষা জীবন শেষ করতে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠ-খড় ; তবুও থেমে থাকেনি ইচ্ছে পূরণের জীবন। শুরুতে প্রথম ৫ বছর চাকুরী; এর পরে জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। চাকরি এবং ব্যবসা করাকালীন যখন যে অবস্থায় ছিলেন পরিবারের মাসিক নিয়মিত খরচ কমিয়ে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যাংকে জমা করতেন। এভাবে ১৫ বছর ধরে জমা করার পর স্থির করলেন এ টাকাই নিজ এলাকার মানুষের সেবায় মা-বাবার নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করবেন। যেই চিন্তা, সেই কাজ। পৈত্রিক  বাড়ির সামনে নিজস্ব ৫০০ স্কয়ার ফুট জায়গায় গড়ে তুললেন ছাদ জমানো  একটি পাকা ভবন।

মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘আহমদ সুফিয়া’ দাতব্য  চিকিৎসালয় নামের এই ভবনে সপ্তাহে একদিন দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান সেবা। বর্তমানে এ চিকিৎসাসেবা পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন এলাকার গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষ। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না ধনী পরিবারগুলোও। এই মানবিক উদ্যোগে এলাকার লোকজন সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি মানুষের মাঝে পড়েছে ব্যাপক সাড়া। তাঁর আশা, শুধু নিজে নয় এ কার্যক্রম দেখে উদ্বুদ্ধ হবেন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা।

যাদের আন্তরিক ছোঁয়ায় প্রাণে বেঁচে যাবে অনেক অসহায় মানুষ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে তাঁর অনুপস্থিতিতেও এ দাতব্য চিকিৎসালয় যাতে চালু থাকে তারও ব্যবস্থা রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। 

বলছিলাম-চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রূপকানিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস এর কথা। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর পার্ক ভিউ হসপিটালের প্রতিষ্ঠা কালীন পরিচালক। 

জানা যায়, সাতকানিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রূপকানিয়া এলাকার একটি ছাদ জমানো পাকা ভবনে চলতি বছরের ২৩ মে চিকিৎসা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এই দিন ২৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় ১০০০ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধও প্রদান করেন। এরপর থেকে সপ্তাহের প্রতি সোমবার দুপুর দুইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে। 

সম্প্রতি আহমদ সুফিয়া দাতব্য চিকিৎসালয় এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, একটি পাকা ভবনের মাঝখানের একটি কক্ষে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখছেন। রোগের চাহিদা মত দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যের ওষুধ। আবার অনেক রোগীকে তাৎক্ষণিক ডায়াবেটিস ও প্রেসার পরীক্ষাও করা হচ্ছে বিনামূল্যে। ওই চিকিৎসককে সহায়তা করছেন একজন ডিপ্লোমাধারী নার্স (সেবিকা)। রোগীদের চিকিৎসার সার্বিক সহায়তার জন্য রয়েছেন দু’জন সহকারী। এ ভবনের দক্ষিণে আরেকটি কক্ষে বসে আছেন ২০-২৫ জন রোগী। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। কক্ষে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেক রোগী বাইরে অপেক্ষা করছেন। কক্ষের উত্তর পাশের একটি ছোট জায়গায় রাখা আছে বিনামূল্যে প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ। 

নিজ সন্তানের জ্বর, সর্দি ও কাশির চিকিৎসা নিতে এ চিকিৎসালয়ে এসেছেন পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রূপকানিয়ার এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম। তাঁর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, চিকিৎসক খুব যত্ন সহকারে আমার ছেলেকে দেখেছেন। কোন ফিস নেননি। আবার বিনামূল্যে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ওষুধও। 

এ দাতব্য চিকিৎসালয় থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ওয়াহিদের পাড়া থেকে শরীরের ফুলা ও বাত ব্যথা নিয়ে ৬২ বছর বয়সী মমতাজ বেগম এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তিনি বলেন, আমি তৃতীয় বারের মত চিকিৎসা নিতে এসেছি। আগে অসুস্থতার কারণে চলাফেরা করতে পারতাম না। এখন অনেকটা সুস্থতা বোধ করছি। একইভাবে মধ্য রূপকানিয়ার পার্শ্ববর্তী মনু সিকদার পাড়া থেকে পায়ের ব্যথা নিয়ে এসেছেন দিলোয়ারা বেগম ও আমিন শরীর। তারাও চিকিৎসায় উপকার পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। 

একইভাবে নিজের ডায়াবেটিস ও প্রেসারের জন্য চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিলকিস খাতুন নামে ৬৫ বছর বয়সী এক নারী। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় এ হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর থেকে আমি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত শরীর চেকআপ করি। এখানে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় না কোন টাকা। আবার বিনামূল্যে দেওয়া হয় ওষুধও। ফলে আমার ব্যক্তিগত ও এলাকার গরীব ও দু:খীদের অনেক উপকার হচ্ছে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি এলাকায় সন্তান ফয়সল ইউনুস যাতে এ সেবা অব্যাহত রাখতে আল্লাহ তাকে তৌফিক দেন।

এলাকাবাসী জানান, পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড মধ্য রূপকানিয়া থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এছাড়া এ ওয়ার্ডের কাছাকাছি নেই কোন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। তাৎক্ষণিক কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের কোন বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক সময় জরুরি কোন রোগী পথের মধ্যে বেশি অসুস্থ অথবা মারাও যায়। অন্তত: এ চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে যদি প্রাথমিক চিকিৎসাটা পাওয়া যায় তাহলে অনেক রোগী বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

এ চিকিৎসালয়টি পরিচালনায় জন্য রয়েছে একটি কমিটি। আট সদস্যের এ কমিটিতে ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস চেয়ারম্যান, তাঁর স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা সদস্য সচিব, বড় ভাই আবু ইউসুফকে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। চিকিৎসক শফিউল করিম ইলিয়াসকে ভাইস চেয়ারম্যান, এলাকার সমাজসেবী আবুল হোসেনকে অর্থ সচিব, আনোয়ার হোসেনকে সমাজ সেবা সচিব, মুশারত হোসেনকে সহকারী সদস্য সচিব এবং আরিফ মাঈনুদ্দিন ও মিনহাজ উদ্দিনকে সদস্য করা হয়েছে। 

এ চিকিৎসালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আবুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন জানান, বর্তমান সময়ের ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার মাঝে এমন একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র বড়ই সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ভবিষ্যতে এই সেবার পরিধি আরো বিস্তৃত করা হবে এবং আরো বেশি সংখ্যক রোগী যেন উপকৃত হতে পারেন সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। 

এ দাতব্য চিকিৎসালয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী এমবিবিএস ও বিসিএস ডিগ্রিধারী মেডিসিন স্পেশালিস্ট মো.বেলাল উদ্দিন বলেন, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সপ্তাহের প্রতি সোমবার দুপুর দুইটা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হয় রোগীদের। প্রতিবারই কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। এখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় জ্বর, কাশি, সর্দি ও এলার্জির চিকিৎসা ও ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। প্রয়োজন অনুয়ায়ী দামী এন্টিবায়োটিকও রোগীদের দেওয়া হয়। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও প্রেসারেরও পরীক্ষা করা হয় সম্পূর্ণ ফ্রিতে। অনেক রোগী দ্বিতীয়বার ফলোআপের জন্যও আসে। যদি এ সেবা কার্যক্রম নিয়মিত চালু থাকে তাহলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী অনেক বেশি উপকৃত হবে। 

এ দাতব্য চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ছাত্র জীবন থেকে মানুষকে সেবা দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই ১৫ বছরে জমানো ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়ে মা-বাবার নামে এই  চিকিৎসালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছি। আমার আশা, এ কার্যক্রম দেখে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে।  

ফয়সল ইউনুস বলেন, চাহিদার প্রেক্ষিতে চিকিৎসা কার্যক্রম বর্ধিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দাতব্য চিকিৎসালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমার অবর্তমানেও যাতে এই চিকিৎসালয়ের কার্যক্রম চলমান থাকে সে চেষ্টা আমি সাধ্যমত করে যাব। 

সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইব্রাহিম চৌধুরী বলেন, নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানের নজির খুবই হাতেগোনা। এভাবে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে অসহায় মানুষ খুবই উপকৃত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা স্থায়ীভাবে অপসারিত হবেন
পরবর্তী নিবন্ধ৩৮ লাখ টাকার বিনিময়ে নথি হস্তান্তর, কর কর্মকর্তা বরখাস্ত