দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জাহাজ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জাহাজজটসহ শিপিং বাণিজ্যে সংকট তৈরি হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যে সমস্ত কন্টেনার জাহাজ চলাচল করছে তার মধ্য থেকে কমপক্ষে ১৫ টি জাহাজ কমিয়ে ফেলার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। অবশ্য শিপিং এজেন্সিসহ শিপিং ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা বিষয়টিকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গতিশীল রাখতে হলে জাহাজ চলাচল বাড়াতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরে একইসাথে ১৬টি জাহাজ বার্থিং দেয়া সম্ভব হয়। এর মধ্যে দশটি কন্টেনার জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একই সাথে দশটির বেশি কন্টেনার জাহাজ বার্থিং দিতে পারে না। বন্দরে জাহাজ চলাচলের মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বাড়তে থাকে। এছাড়াও জেটিতে থাকা জাহাজে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য লোড–আনলোড সম্পন্ন করতে না পারলে নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ যাত্রা করতে পারে না। ফলে জাহাজের টার্ণ এ্যারাউন্ড টাইম বেড়ে যায়।
চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলের জন্য মোট অনুমোদিত কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা ছিল ৯৬ টি। ওই সময় বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বা ওয়েটিং টাইম ছিল ১ থেকে ২ দিন এবং অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা ছিল ৭ থেকে ৮টি। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে এডহক ভিত্তিতে কিছু জাহাজ চলাচলের অনুমোদন পাওয়ায় বর্তমানে মোট কন্টেনার জাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৮ টিতে। ফলে জাহাজ জট বেড়ে গেছে। বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বা ওয়েটিং টাইম বাড়ছে, বাড়ছে বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যাও। এতে বর্হিবিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে এবং নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২০ জুলাই উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকের আয়োজন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কন্টেনার শিপিং এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তারা পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরে জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনার উপর গুরুত্বারোপ করেন। বন্দরের কর্মকর্তারা বলেন, জাহাজের সংখ্যা ৯৬ থেকে ১০০টির মধ্যে নির্দিষ্ট রাখা উচিত। এর বেশি হলেই বন্দরের সমস্যা তথা দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের সমস্যা হবে।
বন্দর বোর্ড রুমে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় বাংলাদেশ কন্টেনার শিপিং এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বন্দরের একটি অন্যতম বড় স্টেকহোল্ডার। আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে গতিশীলতা ধরে রাখতে তারা অধিক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নতুন জাহাজ বন্দরে চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কম ধারণ সম্পন্ন জাহাজ বন্দরে আনলে কিংবা এডহক ভিত্তিতে অনুমোদন প্রাপ্ত জাহাজ যদি নিয়মিত কার্গো নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে না পারে তাহলে ফ্রেইট সহ অন্যান্য চার্জ বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশের আমদানি–রপ্তানি বানিজ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
সভায় উভয়পক্ষের বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দেয় যে, ২৭ জুলাই তারিখের মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি জাহাজ কমিয়ে তার তালিকা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট প্রদান করতে হবে। কিন্তু ২৭ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন কিংবা বাংলাদেশ কন্টেনার শিপিং এসোসিয়েশন একটি জাহাজও কমাতে পারে নি, এই ব্যাপারে কোন তালিকাও প্রদান করতে পারেনি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২৯ জুলাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫টি জাহাজের তালিকা প্রদানের তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু গতকাল ২৪ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলেও কোন জাহাজের তালিকা দেয়া সম্ভব হয়নি বলে শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা তালিকা দিইনি, তবে একটি চিঠি দিয়েছি। আমরা বলেছি জাহাজ কমালে বন্দরের ইমেজ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যবসা বাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি ঈদের দশ দিনের ছুটি, বার্থ অপারেটরদের গো স্লো, কাস্টমসের কলম বিরতীসহ বিভিন্ন কারণে বন্দরে জট তৈরি হয়েছে। এক মাসের মধ্যে সমস্যা কোথায় সেটি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে জট থাকবে না। আমরা সেই সমস্যগুলো চিহ্নিত করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। প্রয়োজনে আমরা সবাই মিলে সমন্বিতভাবে সমস্যার সমধান করবো।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের আরও অধিক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ বন্দরমুখী করতে হবে। জাহাজ কমালে আমদানি–রপ্তানির খরচ বাড়বে, যা দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি আরও জানান, উন্নত বিশ্বের কোন বন্দরেই জাহাজ সংখ্যা কমানোর প্রবণতা নেই। বরং তারা ‘মার্কেটিং ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ উন্নয়নের মাধ্যমে জাহাজ আকৃষ্ট করে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জট পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য জাহাজ কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থেই এটি করা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ডেপুটি কনজারভেটরকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বলেও তিনি জানান। কমিটির অপরাপর সদস্যরা হচ্ছেন ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার, টার্মিনাল ম্যানেজার, সহকারী হারবার মাস্টার, সহকারী ট্রাফিক ম্যানেজার এবং বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের একজন প্রতিনিধি। কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।