ডিম আহরণে অনেক প্রতীক্ষা। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান হলো। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। এবার হালদা থেকে প্রায় ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। গত বছর সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। ২০২৩ সালে সংগ্রহ হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুসারে, হালদা নদীতে গতকাল ৫৫০ জন ডিম সংগ্রহকারী ২৫০টি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করতে নামেন। গতকাল পর্যন্ত তারা প্রায় ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন। হালদা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবার ভালো ডিম সংগৃহীত হয়েছে। বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পেরে খুশি আহরণকারীরা। ফলে হালদার দুই পাড়ে এখন উৎসবের আমেজ।
লঘুচাপের কারণে নদীতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়। গত বৃহস্পতিবার সকালে নমুনা ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। পরে একই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার পর থেকে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। এর আগে গত মঙ্গলবার প্রথম দফায় মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছিল।
গত এপ্রিলে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার দুটি তিথি চলে গেছে। এছাড়া চলতি মে মাসে পূর্ণিমার একটি তিথিও চলে গেছে। কিন্তু বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ও নদীতে ঢলের প্রকোপ না থাকায় মা মাছ ডিম ছাড়েনি। এখন অমাবস্যা জো/তিথি চলছে। এই তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত তেমন না থাকলেও গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ও সাড়ে ১১টার দিকে হালদা নদীর গড়দুয়ারা নয়াহাট, সিপাহিরঘাট, মাছুয়াঘোনা, আজিমেরঘাট, ঝোরারমুখ, কেরামতলি, নাপিতেরঘাট, কুমারখালী, আমতুয়া কাগতিয়ার টেকসহ নদীর বিভিন্ন স্থানে নমুনা ডিম পাওয়া গেছে। নমুনা ডিমের আলামত পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম আহরণের সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে নামেন।
মদুনাঘাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে সকালে নমুনা ডিম, পরে রাতে মা মাছের ডিম ছাড়ার কথা নিশ্চিত করে বলেন, লঘুচাপের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ মাদার্শা, মদুনাঘাট, উত্তর মাদার্শা ও গড়দুয়ারাসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর পানি ঢুকে পড়েছে। এলাকার চলাচলের রাস্তা, উঠানে নদীর পানি ঢুকেছে। পানিতে লবণাক্ত বলে জানান তিনি। লবণাক্ত পানিতে ছাড়া ডিম থেকে রেণু তেমন ফুটে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ডিম সংগ্রহকারী গড়দুয়ারার কামাল সওদাগর জানান, সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থাকলে মাছ ডিম ছাড়ে না। তবে বাতাসের তীব্রতায় নদীতে প্রবল ঢেউয়ের সৃষ্টি হলে অনেক সময় মাছ ডিম ছাড়ে। গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার পর মা মাছ নদীতে ডিম দেওয়া শুরু করে। তারা সেই সময় থেকে ডিম সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ডিম ছাড়ার পরিমাণ আশানুরূপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার ১০টি নৌকায় প্রায় ৩৫ বালতি ডিম আহরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৪০ মিনিট থেকে গতকাল শুক্রবার ২টা পর্যন্ত ডিম ছেড়েছে বলে জানান তিনি।
এবার হালদা নদী থেকে প্রায় ২ হাজার বালতি ডিম সংগৃহীত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন; যার আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কেজি।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ২টার পর জোয়ারের সময় হালদা নদীর আমতুয়া অংশে কার্পজাতীয় মা মাছ পূরোদমে ডিম ছাড়ে। পরবর্তীতে ডিমগুলো হালদা নদীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যারা প্রথম দিকে ডিম সংগ্রহ করতে নদীতে ছিল তারা অধিক ডিম সংগ্রহ করেছে। ডিম সংগ্রহকারীরা গড়ে দুই থেকে আড়াই বালতি করে ডিম সংগ্রহ করেছে। কাঙ্ক্ষিত ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ডিম সংগ্রহকারীরা আনন্দিত। বর্তমানে ডিম সংগ্রহকারীরা হ্যাচারি ও মাটির কুয়ায় ডিম ফোটানোর কাজে ব্যস্ত।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে হালদা নদীতে রুই জাতীয় ব্রুট মাছ ডিম ছেড়েছে। নদীর পাড়ের প্রায় ৫৫০ জন ডিম সংগ্রহকারী প্রায় ২৫০টি নৌকা নিয়ে উৎসব সহকারে ডিম সংগ্রহ করছেন। ভোরের দিকে একটু বৈরী আবহাওয়ায় স্বাভাবিক ডিম সংগ্রহে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। দুপুর ২টা পর্যন্ত কিছু ডিম সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ করেন। তবে সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবার ভালো পরিমাণ ডিম সংগৃহীত হয়েছে।
তিনি বলেন, মদুনাঘাট ছায়ার চর থেকে রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতারঘোনা, আজিমেরঘাট, মাচুয়াঘোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি, সিপাহিঘাট, নোয়াহাট, কেরামতালির বাঁক এবং অঙ্কুরিঘোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ডিম সংগ্রহকারীরা খুশি। অনেকে প্রতি নৌকায় ৪/৫ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারি এবং মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্য সংগ্রহ এবং নদীর সার্বিক পরিবেশ মনিটরিং করছে।
ড. মঞ্জুরুল বলেন, আমি মনে করি, আজকের ডিম প্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনজিও আইডিএফ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সমন্বিতভাবে নিরলসভাবে কাজ করছে হালদা নদী রক্ষায়। হালদা নদী বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার একটি সফল উদাহরণ।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে সরকার সাতটি বিভাগের আটটি নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে হালদা নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হালদা বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেখানে নদীর ৬০–৭০% ভাগ ইতোমধ্যে দূষণমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। ভূজপুর রাবার ড্যাম নিয়ন্ত্রণ, মানিকছড়ির তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, পোল্ট্রি বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং কাটাখালী কৃষ্ণখালী এবং খন্দকিয়া খালের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শতভাগ দূষণমুক্ত করা সম্ভব হবে। আমি আশা করছি, বর্তমানের সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকলে প্রতি বছর হালদা নদীর ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং বর্তমানে সংরক্ষিত মৎস্য হেরিটেজ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় ৭ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ডিম আহরণকারীদের প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে। বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পেরে তারা খুশি। প্রসঙ্গত, গত তিনটি জো’তে মাছ ডিম না ছাড়ায় ডিম আহরণকারীরা কোরান খতম, দোয়া মাহফিল ও শিরনি বিতরণের আয়োজন করেছিলেন।