মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ মমতার হাত বাড়িয়েছিল। একে একে ৫টি বছর পার করেছে। কিন্তু সেই মমতাকে পুঁজি করেই রোহিঙ্গাদের অনেকে এখন অপরাধী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে কমপক্ষে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে ১০ হাজার রোহিঙ্গা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। দিন যত গড়াচ্ছে ততই ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। খুন, অপহরণ, মাদক, ডাকাতি, অস্ত্র পাচার, জাল টাকাসহ ১২ ধরনের অপরাধের অভিযোগে প্রতিদিন কোনো না কোনো শিবির থেকে আটক হচ্ছে তারা। নিজেদের ভয়ঙ্কর অপরাধ করার পাশাপাশি ভাড়াটে হিসেবে খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি করে যাচ্ছে তারা। গ্রেপ্তার ও আইনি ব্যবস্থা নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
পুলিশ বলছে, ইয়াবা, আইস ও ফেনসিডিলসহ নানা মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় পরিচয় গোপন করে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা এখন কন্ট্র্যাক্ট কিলিংয়ের মতো বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গত ২ বছরে ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার, খুন, ধর্ষণ, চোরাচালান ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ৪৭৩ মামলা তদন্তাধীন। এতে আসামির সংখ্যা ১০৮৮। এছাড়া ১ হাজার রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিগত ২ বছরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৭৭ রোহিঙ্গা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে হিংস্র হয়ে উঠছে তারা। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ। ক্যাম্পে আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়ই সংঘাত হচ্ছে। ব্লকে ব্লকে মাদক, মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু কিছু ঘটনা খুন পর্যন্ত গড়াচ্ছে। মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্প হয়ে প্রতিদিন শত কোটি টাকার ইয়াবা ও নতুন মাদক ক্রিস্টাল মেথ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর তৎপরতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ ও জমিয়তুল মুজাহিদীনের সাংগঠনিক তৎপরতা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাধারণ ঘটনা। রোহিঙ্গা অপরাধীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় কিছু দালাল। এই দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। তাই ড্রোন ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। চালানো হচ্ছে বিশেষ অভিযান। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মানব পাচারকারী চক্র। ইতোমধ্যে এই চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, মাদক বহন ও কেনাবেচাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। গত ছয় বছরে (২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ৪৬২ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছ থেকে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৮২৫ পিস ইয়াবা, এক লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং তিনটি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। অধিদফতর সূত্র আরও জানায়, অভিযানে ২০১৭ সালে ১৩, ২০১৮ সালে ৩০, ২০১৯ সালে ২৬, ২০২০ সালে ৯১, ২০২১ সালে ১৮৬ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে মাদক, টাকা ও সোনার বারসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গারা এখন উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক বেচাকেনা ও বহনে ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। সমপ্রতি তাদের কাছ থেকে তিনটি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা শুধু মাদক বেচাকেনা ও বহনে সীমাবদ্ধ নয়; সোনা চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছে।
২৯ জুলাই রাতে সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে দেড় কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণের বারসহ মা-ছেলেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারা রোহিঙ্গা হয়েও মিথ্যা পরিচয়ে সলিমপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিল। র্যাব বলছে, ইয়াবা বিক্রির লভ্যাংশ দিয়ে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে স্বর্ণের বার উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পগুলোতে পাচার করে আসছে। পরে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এপিবিএন-১৬-এর অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকায় সাত মাসে ৩০টি অপহরণের ঘটনায় দুজন বাংলাদেশিসহ ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় পাঁচটি মামলায় সাত অপহরণকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বেশিরভাগ অপহরণ মাদকের কারণে ঘটেছে। এসব ঘটনায় রোহিঙ্গারা জড়িত।












