ভূমি সংকটের সুরাহা হওয়ার দিন কয়েকের মাথায় দেশের আগামী একশ’ বছরের বন্দর হিসেবে খ্যাত বে টার্মিনাল নির্মাণে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ (এডি পোর্টস)। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি হোটেলে এডি পোর্টস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ), নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং এডি পোর্টসের বাংলাদেশ এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেকের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এডি পোর্টস গ্রুপের সাথে এই চুক্তি বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পকে অনেক বেশি গতিশীল করবে বলে সূত্রগুলো আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী এমপি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এবং আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফ আল মাজরুয়ি। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, হালিশহর এলাকার বঙ্গোপসাগরের উপকূলে জেগে উঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে ৯৩৯ একর ভূমির উপর বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। শুরুতে ৬৮ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি হুকুমদখল করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বে টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করলেও বাকি ভূমির অভাবে প্রকল্পটি থমকে যায়। নানা প্রক্রিয়া এবং আনুষ্ঠানিকতার পর সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে প্রতীকি মূল্যে আরো ৫০০ একর ভূমি পেয়েছে। এই ভূমি পাওয়ায় বে টার্মিনাল প্রকল্পের একটি বড় বাধা দূর হয়। ভূমির সংস্থান হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই আবুধাবী পোর্টস গ্রুপ বে টার্মিনালে ১বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করলো। ব্যাপারটিকে বে টার্মিনাল নির্মাণ কাজে বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। গতকাল এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর বে টার্মিনাল প্রকল্প নিয়ে নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছে বলেও বন্দর সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
বে টার্মিনাল প্রকল্পে সাগর থেকে মোট ১৬শ’ একর ভূমি রিক্লেইম করার পরিকল্পনা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাগর ভরাট করে উদ্ধার করা ভূমিতেই নির্মিত হবে বে টার্মিনালের অবকাঠামো। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রিক্লেইমের ঘটনা বলেও মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। হামবুর্গ পোর্ট কনসালটেন্ট (এইচপিসি) সেলহর্ন এবং বাংলাদেশের কেএস নামের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান বছর ব্যাপী সার্ভে করে বে টার্মিনালের ব্যাপারে যেই রিপোর্ট উপস্থাপন করেছে তাতে সাগর ভরাট করে ভূমি উদ্ধার করে স্ট্রাকচার এবং সুপার স্ট্রাকচার নির্মাণের বিষয়টি রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বে টার্মিনালের জন্য ব্রেক ওয়াটারের নির্মাণ করতে হবে। এটিই হবে দেশের প্রথম কোন ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ কাজ। উপকূল থেকে অন্তত এক কিলোমিটার অংশ ভরাট করে সাগরের বেশ গভীরে গিয়েই জেটি নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় উপকূলে নির্মিত জেটিতে প্রত্যাশিত ড্রাফট পাওয়া যাবে না। ১৪/১৫ মিটার ড্রাফটের জন্য বেশ গভীর পর্যন্ত সাগর ভরাট করতে হবে। এই ভরাট প্রক্রিয়ায় শত শত কোটি টাকার ভূমি রিক্লেইম হবে। বে টার্মিনালের এলাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে আড়াই হাজার একরে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চলে কেবলমাত্র সাড়ে চারশ’ একর ভূমিতে। এতে করে বিদ্যমান বন্দরের পাঁচ গুনেরও বেশি বড় এলাকায় বে টার্মিনালের কার্যক্রম চলবে। বে–টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি পিপিপি (সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব) এবং জি টু জি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার জন্য প্রশাসনিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকেই গতকাল এডি পোর্টস গ্রুপের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।
বন্দর সূত্র জানায়, টার্মিনালটি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে ১০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার এবং ৭০ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডলিং করতে পারবে। এতে দেশের আমদানি ও রপ্তানি দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহন খরচ এবং সময় বহুলাংশে কমে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল দিনকয়েক আগে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বে টার্মিনালের অর্থায়নের জন্য এডি পোর্টসের প্রাথমিক প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। তবে নন–বাইন্ডিং সমঝোতার সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বে টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় মোট ৪টি টার্মিনাল নির্মিত হবে। এর মধ্যে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের বিনিয়োগ সহায়তায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে বলেও বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান।
বে টার্মিনালের চ্যানেল তৈরিতে মোট বিনিয়োগ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ব্রেক ওয়াটার, ট্রাক টার্মিনালসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বিনিয়োগ হবে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। আরো বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
বন্দর সূত্র জানায়, বে টার্মিনাল প্রকল্পের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং দুটি কন্টেনার টার্মিনালে বার্থের দৈর্ঘ্য হবে তিন হাজার ৯৫০ মিটার। এর মধ্যে মাল্টিপারপাস টার্মিনালে বার্থের দৈর্ঘ্য দেড় হাজার মিটার। মাল্টি পারপাস টার্মিনালের মোট বার্থসংখ্যা ৫টি। টার্মিনালে প্যানামেঙ ক্লাসের কন্টেনার জাহাজ, বাল্ক ক্যারিয়া, রো রো শিপ ইত্যাদি জাহাজ ভিড়তে পারবে। দুটি কন্টেনার টার্মিনালের প্রতিটির বার্থ এরিয়া হবে এক হাজার ২২৫ মিটার করে। কন্টেনার টার্মিনালে বার্থের সংখ্যা ৪টি করে মোট ৮টি হবে বলেও বন্দর সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে এডি পোর্টস গ্রুপের স্থানীয় এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সাংবাদিকদের জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে সকল কমপ্লায়েন্স মেনেছে এডি পোর্টস গ্রুপ। এই টার্মিনাল দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরণের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০ মিটার ল্যান্থের জাহাজ ভিড়াতে পারে। বে টার্মিনালে ১২ মিটার ড্রাফট এবং ২৮০ মিটার ল্যান্থের জাহাজ অনায়াসে বার্থিং নিয়ে কন্টেনার কিংবা পণ্য হ্যান্ডলিং করতে পারবে। যা দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন ব্যয় এবং সময় অনেক কমিয়ে দেবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগের লক্ষ্যে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপের একটি ননবাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্ব ও উন্নয়নে একসাথে কাজ করার জন্য এই ননবাইন্ডিং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমীরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আবদুল্লাহ খাসেইফ আল হুমুদিসহ এডি পোর্টস গ্রুপ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সাইফ পাওয়ারটেকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, এডি পোর্ট গ্রুপের ৫টি সমন্বিত বিজনেস ক্লাস্টার ডিজিটাল, ইকোনমিক সিটিস এন্ড ফ্রি জোন, লজিস্টিকস, মেরিটাইম এবং পোর্ট রয়েছে। আবুধাবি অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ মাকতা গেটওয়ে এডভান্সড ট্রেড এন্ড লজিস্টিক প্লাটফরম তৈরি এবং পরিচালনা করেছে। যা আবুধাবি জুড়ে বাণিজ্য ও লজিস্টিক নৌ, স্থল ও আকাশ পথের পরিষেবাগুলোকে একীভূত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমসহ বে–টার্মিনাল প্রকল্পে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে যৌথভাবে এডি পোর্ট গ্রুপের বিনিয়োগ চুক্তি বাংলাদেশে উল্লেযোগ্য পরিমানে বিদেশী বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।