সিরিজটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল প্রথম দুই ম্যাচেই। তবে শেষ ম্যাচটায়ও অনেক কিছুই অর্জনের ছিল বাংলাদেশের। ভারতের মত দলকে হোয়াইটওয়াশ করার সুযোগ ছিল টাইগারদের সামনে। হোয়াইটওয়াশ করা তো হয়ইনি, উল্টো ভারতের রানের নিচে চাপা পড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেছে বাংলাদেশ। ভারত চেয়েছিল এই ম্যাচটি জিতে অন্তত হোয়াইটওয়াশের লজ্জাটা যেন এড়াতে পারে। কিন্তু কে জানতো তাদের মনে এতটা ক্ষোভ জমা ছিল। না হয় ইশান কিশান নামের এক তরুণ কেন এমন তাণ্ডব চালাবেন। কেন এতবড় রানের পাহাড়ের নিচে চাপা দেবে বাংলাদেশকে। নিজেদের লাকি গ্রাউন্ডে বড় লজ্জাই পেতে হলো বাংলাদেশকে। হেরেছে ২২৭ রানের বিশাল ব্যবধানে। যা ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় পরাজয়। আগেরটি ছিল ২৩৩ রানের। ২০০০ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ সেটি। শুধুই কি বড় হার? সে সাথে সঙ্গী হয়েছে একাধিক লজ্জার। বাংলাদেশের বিপক্ষে কেনো ব্যাটসম্যানের ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি, চারশর বেশি রানের ইনিংস। আরো কত কি।
বিশ্ব ক্রিকেটে সেরা ব্যাটিং লাইন ভারতের। সেটা নিশ্চয়ই রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, কে এল রাহুলদের কল্যাণে অবশ্যই। রোহিত শর্মার তো ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি রয়েছে তিনটিই। তাই বলে ইশান কিশান নামক একজন তরুণ করবেন এমন কাণ্ড। অবশ্য এই
জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ান বোলার জেসন গিলেস্পির নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে খেলতে নেমে ডাবল সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব রয়েছে। যদিও সেটা টেস্ট ক্রিকেটে। তবে এবারে ইশান কিশান কীর্তি গড়লেন ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করে। তাও বিশ্বে দ্রুততম। প্রতিপক্ষের একজন ব্যাটসম্যান যখন এমন ব্যাটিং করে তখন আসলে সেদিন অন্যদের কিছুই করার থাকে না। যেমনটি করতে পারেনি বাংলাদেশ গতকাল। যথারীতি লজ্জার হার দিয়ে সিরিজ শেষ করতে হলো। আর সিরিজ হারানো ভারত শেষটা রাঙালো একেবারে ঝলমলে দিনের মত রঙিন আভা ছড়িয়ে। যেন আগের দুই ম্যাচে হারের প্রতিশোধ তুলে নিল একেবারে কড়ায়-গণ্ডায়।
টসে জিতে প্রথম বল করার সিদ্ধান্তটাকে যথার্থই মনে হচ্ছিল দিনের শুরুতে। যখন মাত্র চতুর্থ ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজ ফিরিয়ে দিলেন শিখর ধাওয়ানকে। ভারতের খাতায় তখন জমা পড়েছে মাত্র ১৫ রান। এরপর ওপেনার ইশান কিষানের সাথে যোগ দেন বিরাট কোহলি। সব স্পটলাইট নিশ্চয়ই তখন এই কোহলিকে ঘিরে। কারণ সিরিজে প্রথম খেলতে নামা ইশান কিষানকে কে আর তেমন টার্গেট করবে। কিন্তু কে জানতো এই ইশান কিষানই বাংলাদেশের বোলারদের কঁচুকাটা করবে। যে ওভারে শিখর ধাওয়ানকে আউট করেন মিরাজ তার পরের ওভারে আরও একটি উইকেট পেতে পারতেন। শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন কোহলি। কিন্তু সহজ ক্যাচ ফেলে দেন লিটন। ১ রানে জীবন পান কোহলি।
এরপর শুরু হয় কিশান তাণ্ডব। কেবলই চার আর ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটাচ্ছিলেন এই বাঁহাতি। অপর প্রান্তের অভিজ্ঞ বিরাট কোহলিকে একেবারে দর্শক বানিয়ে রেখেছিলেন কিশান। যেদিক থেকেই বল আসছিল ঠিক সেদিকেই ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন চার আর ছক্কার মাধ্যমে। ১৫ রানে ভারত প্রথম উইকেট হারানোর পর কিশান-কোহলি মিলে গড়েন ১৯০ বলে ২৯০ রানের বিধ্বংসী জুটি। বলার অপেক্ষা রাখে না এর মধ্যে বেশি ভয়ংকর ছিলেন কিশান। ৮৫ বলে ঝড়ো সেঞ্চুরি করা এই বাঁ-হাতি ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটিকে রূপ দিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরিতে। তাও মাত্র ১২৬ বলে। যেটি কিনা ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড। ইশান ৪৯ বলে করেন ৫০ রান। পরের ৫০ রান করতে বল খেলেন ৩৬ বল। অর্থাৎ ৮৫ বলে সেঞ্চুরি করেন ইশান। এরপর টর্নেডোর গতিতে চলেছে তার ব্যাট। বল কোন ধরনের তারও যেন পরোয়া নেই। কেবলই ব্যাটটাকে চালিয়েছেন ধারালো তরবারির মত করে। যেন দুধারি তলোয়ার। যেদিকে যাচ্ছে আর সেদিকে কাটছে। ইশান ১৫০ রান করেন ১০৩ বলে। অর্থাৎ তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরিটা তিনি তুলে নিয়েছেন মাত্র ১৮ বলে। স্বপ্নের ডাবল সেঞ্চুরি পুরণ করেন ১২৬ বলে। যেখানে তার চতুর্থ হাফ সেঞ্চুরিটা এসেছে ২৩ বলে। রেকর্ড গড়া এই ইনিংসটি শেষ হয় তাসকিনের বলে লিটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে। ততক্ষণে ইশান তুলে নিয়েছেন ২১০ রান। আর সে জন্য বল খেলেছেন ১৩১টি। যেখানে চার মেরেছেন ২৪টি আর ছক্কা মেরেছেন ১০টি। যতক্ষণ ইশান উইকেটে ছিলেন ততক্ষণ শান্ত ছিলেন কোহলি। কিন্তু ইশান আউট হওয়ার পর মারমুখি হয়ে উঠেন তিনিও। তিনিও তুলে নেন আরেকটি সেঞ্চুরি। এটি তার ক্যারিয়ারের ৪৪ তম সেঞ্চুরি। তাও আসল প্রায় ৪০ মাস পর। সেঞ্চুরির দিক থেকে তিনি টপকে গেছেন রিকি পন্টিংকে। সামনে এখন কেবল শচীন টেন্ডুলকার। ৯১ বলে ১১৩ রান করে ফিরেন কোহলি। আর তাতেই ভারতের স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ৪০৯ রানে। প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিপক্ষে চারশ রানের ইনিংস গড়ল কোনো দল। যা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর। এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪১৮ রান ছিল তাদের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর। এছাড়া শ্রীলংকার বিপক্ষে ৪১৪ এবং বারমুড়ার বিপক্ষে ৪১৩ রান করেছিল ভারত। বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো দলের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর। এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ভারতের সবচেয়ে বড় দলীয় সংগ্রহটি ছিল ৪ উইকেটে ৩৭০ রানের। ২০২১ সালে মিরপুরে এই রেকর্ড গড়েছিল ভারত।
৪১০ রানের বিশাল টার্গেট। এমন টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে শুরুটা যেমন হওয়া উচিত তেমনটি করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৩৩ রানের মাথায় ফিরেন এনামুল হক বিজয়। পুরো সিরিজে ব্যর্থ লিটনের ব্যাট হাসেনি এই ম্যাচেও। ফিরেছেন ২৬ বলে ২৯ রান করে। মুশফিকুর রহিমও রানের দেখা পাচ্ছেন না। ফিরেন ১৩ বলে ৭ রান করে। এতবড় টার্গেট টপকে ম্যাচ জেতা যে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব না সেটা বিশ্বাস করা মানুষের অভাব থাকার কথা নয়। কিন্তু জবাবটা যেন একটু সম্মানজনক হয়। ৭৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে সেটাও পড়ে যায় সংকটে। চতুর্থ উইকেটে সাকিবের সাথে জুটি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন চট্টগ্রামের ছেলে ইয়াসির আলি চৌধুরী রাব্বি। কিন্তু সিরিজে প্রথমবারের মত পাওয়া সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারলেন না এই তরুণ। মাত্র ৩৪ রান যোগ করতে পেরেছিলেন দুজন। ইয়াসির ফিরেছেন উমরান মালিকের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে। অবশ্য রিভিউ নিয়ে তাকে ফিরিয়েছে ভারত। ৩০ বলে ২৫ রান করে রাব্বি। সাকিবও পারলেন না দলকে টানতে। ফিরেছেন ৪৩ রান করে, কুলদ্বীপ যাদবের বলে বোল্ড হয়ে। মাহমুদউল্লাহ ফিরেন ২০ রান করে। আফিফ পারেননি এই ম্যাচেও রান করতে। তার অবদান মাত্র ৮ রান। মেহেদী মিরাজ আর কিইবা করবেন। ফিরেছেন ৩ রান করে। শেষ জুটিতে মোস্তাফিজ এবং তাসকিন চেষ্টা করেছেন হারের ব্যবধান কমাতে। মোস্তাফিজের ১৩ আর তাসকিনের ১৭ রানের উপর ভর করে ১৮২ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। ভারত জিতেছে ২২৭ রানে।