চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি নিয়ে নতুন করে আবার তিক্ততার সৃষ্টি হলো। এর আগে ২০১৭ সনে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ‘পুনর্মূল্যায়নের’ নামে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে চট্টগ্রাম শহরবাসীর আন্দোলন ও আপত্তির মুখে মন্ত্রণালয় কর্তৃক হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন (রিএসেসমেন্ট) প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়ে স্থগিত করা হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন (রিএসেসমেন্ট) এর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার জন্য অথবা ১৯৮৬ সনের আইনের আলোকে নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন করার অনুমতি দেয়ার জন্য গত ২ জানুয়ারি ২২ তারিখে মন্ত্রণালয়ে আবেদন প্রেরণ করেন। সেই প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে গত ১৮ জানুয়ারি ২২ তারিখের চিঠিতে ২০১৭ সনের গৃহকর- পুনর্মূল্যায়নের আলোকে গৃহকর আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়।
এরপর হতে জুলাই মাসের শুরু থেকে বর্ধিত গৃহকর আদায়ের লক্ষ্যে চসিকের ৮টি রাজস্ব সার্কেল থেকে বাড়ির মালিকদের নতুন ধার্য করা গৃহকরের নোটিশ পাঠানো হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। যাতে পূর্বের তুলনায় অস্বাভাবিক গৃহকর ধার্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মূলতঃ এরপর হতেই নগরবাসী অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। তবে এই বিষয়ে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হবে না, শুধু করের আওতা বাড়ানো হবে। এতে নগরবাসীর ভয়ের কিছু নেই’। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘ধরেন, আপনার যদি একতলা বাড়িটি একতলাই থাকে, তাহলে আগে যা দিতেন সেই হোল্ডিং ট্যাক্সই দেবেন। কিন্তু যদি সেটি চার-তলা হয়, তাহলে বাকি তিন-তলার ট্যাক্সটা তো দেবেন’। হোল্ডিং ট্যাক্স বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন নিয়মে কর পরিশোধ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে যদি তাঁরা আপিল করেন, তাহলে যতটুকু পারা যায় সহনীয় করা হবে’।
এদিকে গৃহকর বৃদ্ধির প্রতিবাদে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ গত ২ সেপ্টেম্বর তারিখে কদমতলীতে সমাবেশ করেন। সেখানে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘বাড়িভাড়ার উপর গৃহকর ধার্য করায় গৃহকর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কোনো সৎ নাগরিকের পক্ষে এত অধিক পরিমাণ কর পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কর পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আদি চট্টগ্রামবাসীদেরকে বাস্তচ্যুত হয়ে রোহিঙ্গার ভাগ্য বরণ করতে হবে। এখানে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কিছু নেই। করোনাকালিন সময়ে ভেঙে পড়া চট্টগ্রামের অর্থনীতি এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তার উপর অন্যায্য হোল্ডিং ট্যাক্স ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, ১৯৮৬ সনের ‘দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ ও এর হিসাব-নিকাশ আইনটি প্রণীত হয়েছিল সামরিক শাসক এরশাদ আমলে। যেখানে বাড়ির আয়তন অনুযায়ী হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের পরিবর্তে বাড়ি ভাড়ার উপর ট্যাক্স ধার্যের নিয়ম করা হয়েছিল (যা ছিল অন্যায্য)। এরশাদ সরকারের অনেক বিধি-বিধান পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকার বাতিল করেছে। এরশাদ সরকারকে কখনোই দেশের মানুষ বৈধ বলে গণ্য করেন নি। তৎকালীন সময়ে আওয়ামীলীগ-বিএনপিসহ সব বিরোধীদল একত্রিত হয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করেছিল। সুতরাং একটি অবৈধ সরকারের আইন বাস্তবায়ন করার জন্য চসিক কেন বার বার উদ্যোগ নিচ্ছে বা চেষ্টা করছে – সেই প্রশ্ন সবার মনে! আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উক্ত আইনে বাড়ি ভাড়ার উপর নির্ধারিত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাড়ির মালিক যেহেতু বাড়ি ভাড়ার উপর আয়কর দিয়ে থাকেন, তাহলে ভাড়ার উপর আয়করের আদলে আনুপাতিক হারে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হলে এটা কি ডাবল ট্যাক্সিং হবে না ? ১৯৮৬ সনের আইন অনুযায়ী কোনো বাড়ির মালিক যদি মাসিক ৫০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পান, তাহলে তাঁকে প্রতি মাসে ৭,০৮৪/- টাকা এবং বার্ষিক ৮৫,০০০/- টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে। মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়ার উপর যেহেতু বাড়ির মালিক বার্ষিক ‘আয়কর’ দিয়ে থাকেন, তাই আবারও ১৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স এর বিধান সঠিক নয়।
এ প্রশ্নটি তখন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম স্যারও দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত কলামে লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশেই ডাবল ট্যাক্সিং প্রচলিত নেই।‘সিটি কর’ তো আসলে হোল্ডিং ট্যাক্স। হোল্ডিং ট্যাক্স বা প্রপার্টি ট্যাক্স নির্ধারণের নীতি-এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে, আয়কর নিরুপণ করাটা যৌক্তিক হচ্ছে না’। এখানে বড় রকমের ‘ইন্টারপ্রিটিশন বা ব্যাখ্যার ভুল হয়ে যাচ্ছে’।
স্মরণযোগ্য যে, ৩ হাজার বর্গ ফুটের একটি ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করতে বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি টাকার অধিক ব্যয় হয়। এই তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়ি হতে নিজে বসবাসের পর যা ভাড়া আসে সেই টাকা দিয়ে সংসারের সবার ভরণপোষণ, ছেলেমেয়ের লেখা-পড়া, দারোয়ানের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল প্রদান ও মেইনটেনেন্স ব্যয়সহ যাবতীয় খরচের পর অবশিষ্ট কিছু থাকে না। এখন যদি এধরনের ভবনের ভাড়ার উপর মাসিক ৯/১০ হাজার টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়, সেটা হবে রীতিমত অবিচার।
প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৬ সনের আইনে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারনের পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ আছে, যা হয়তো দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। আমাদের চসিকের নাগরিক সেবা সমূহ যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- ২৫% নাগরিক সেবাও নিশ্চিত করা যায় না। প্রতিবছরের জলাবদ্ধতা তো ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। অনেক এলাকায় বর্ষাকালে প্রতিটি বাড়ির নীচতলা পানির নীচে থাকার কারণে ৪/৫ মাস খালি পড়ে থাকে, ভাড়া হয় না। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের শতশত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় (চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ক্ষতিসহ)। এসবের ক্ষতিপূরণ কি সিটি কর্পোরেশন কখনও দিয়েছে? সুতরাং নাগরিক সুবিধার ২৫% মাত্র পূরণ করে বর্তমান হারের পাঁচ/দশ গুণ অতিরিক্ত বা ১৭% ট্যাক্স নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত আদৌ উচিত কিনা বা নৈতিকতা সম্পন্ন কিনা-তা অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে।
আমরা জানি চসিক আয়ের খাত কম। যেমন, হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ প্রাপ্ত আয়, অন্যান্য আয়বর্ধক প্রকল্প হতে প্রাপ্ত আয় এবং সরকারি অনুদান। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য হলো- চসিক বরাবরই সরকার হতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবহেলিত। দীর্ঘ সময়ের মেয়র- মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ব্যর্থ করানোর জন্য বিএনপি সরকার বরাদ্ধ কমিয়েছিল, প্রাক্তন আওয়ামীলীগার ও বিএনপি’র টিকেটে মেয়র নির্বাচিত হওয়া মনজুরুল আলমকে ব্যর্থ করানোর জন্য বরাদ্দে অবহেলা করেছিল আ.লীগ সরকার। সর্বশেষ মন্ত্রণালয় হতে অর্থ বরাদ্দের জন্য ঘুষ দাবীর অভিযোগ তুলে পূর্ববর্তী মেয়র আ.জ.ম.নাছিরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের বিরাগভাজন হয়ে বরাদ্দ লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামবাসী সবসময় অবহেলার শিকার হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে চট্টগ্রামের ছয়জন মন্ত্রী থাকলেও নিজেদের দলাদলির কারণে চট্টগ্রামের কোনো উন্নয়ন হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের মত সোনারডিম পাড়ার হাঁস থাকলেও চসিক এখান থেকে বাড়তি কোনো আর্থিক সুবিধা পায় না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের ‘ট্রাক-লরির’ দাপটে চট্টগ্রামবাসীর নাভিশ্বাস উঠছে প্রতিনিয়ত। এই চট্টগ্রাম বন্দর এবং রেলওয়ে হতে যথাযথ ট্যাক্স আদায় করা গেলে চট্টগ্রামবাসীকে হোল্ডিং ট্যাক্স না দিলেও চলতো।
চট্টগ্রামবাসী মনে করেছিলেন, বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে চসিকের ব্যয় কমিয়ে, অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করে ও মন্ত্রণালয় হতে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে করপোরেশনকে সচল রাখবেন। কিন্তু তিনি আবারও ৩ যুগ আগের স্বৈরচারি সরকারের একটা আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন! মেয়র মহোদয় যদি মনে করেন যে, তিনি আইনের কারণে হোল্ডিং ট্যাক্স পূর্বের হারে রাখতে পারছেন না বা কমাতে পারছেন না, তাহলে আইনটি পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারেন। তাছাড়া বিগত ৩৬ বছর যাবৎ পূর্ববর্তী মেয়রগণ নাগরিকদের কথা চিন্তা করে (আইন থাকা সত্বেও) হোল্ডিং ট্যাক্স অযৌক্তিক হারে না বাড়িয়ে যৌক্তিকভাবে বা সহনীয়ভাবে নির্ধারণ করেছিলেন, এবারও সেভাবেই হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ণয় করা হলে- নগরবাসী স্বস্তি পাবেন, উপকৃত হবেন এবং খুশী হবেন ।
বর্তমান সিটি মেয়র মহোদয় তৃনমুল পর্যায়ের রাজনীতিক। তাঁকে খুব বেশি বুঝানোর প্রয়োজন নেই। তিনি সুদীর্ঘ দিন মাঠের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। একটি ভুল আইনের বাস্তবায়নের চেয়ে নগরীতে বসবাসরত মানুষদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়াই মেয়র মহোদয়ের উচিত বলে আমরা মনে করি। সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পাওয়ার পর তিনি এক সংবর্ধনা সভায় বলেছেন, তিনি চট্টগ্রামের গণমানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। আমরা তাঁর এই বক্তব্যকে বিশ্বাস করতে চাই। তিনি গণমানুষের মনের ভাষা বুঝবেন। আমাদের প্রত্যাশা, অযথা তিক্ততা সৃষ্টি না করে, হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ণয়ের অযৌক্তিক আইন বাতিল করার উদ্যোগ নেবেন এবং আয়তনের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করার ব্যবস্থা করবেন।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।