একসময় বার্মিংহাম প্যালেস ছিল পৃথিবীর রাজপ্রাসাদ। কারণ একটাই, প্রায় ৫০০ বছর এই বাড়ি থেকে পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হতো। পৃথিবীর কোন মহাদেশ ছিল না যেখানে ইউনিয়ন জ্যাক উড়েনি। রুশ এবং জার্মান রাজপরিবারও ছিল বার্কিংহাম প্যালেসের কোন না কোন উত্তরাধিকারী। ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, শীতার্ত ওয়াশিংটনকে আরো শীতল করে তুললো শীতের বৃষ্টি। আমরা হোয়াইট হাউসের পেছনের লবি অতিক্রমের সময় গাড়ী থামালাম। ছাতা মাথায় দিয়ে ইথিওপিয়ান বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়েছে। মাইকের সাউন্ড বক্স তাক করা হয়েছে বাইডেনের কান বরাবর। নিরাপত্তা বাহিনীর কোন বাড়াবাড়ি নেই। মামুনের স্ত্রী ডাঃ স্মৃতি আর মেয়েকে গাড়ীতে রেখে মামুন আমি আর রুনু যোগ দিলাম বিক্ষোভ সমাবেশে। ওদের কথার মুল সুর হলো, আমেরিকা চাইলে আজ’ই প্যালেস্টাইনে গণহত্যা বন্ধ হবে। নেতানিয়াহুর প্রধান মদদদাতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে আক্রমণ করা হচ্ছিল তীব্র ভাষায়। অনেকক্ষণ সেই বিক্ষোভে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, পৃথিবীর অন্য কোন রাজপ্রাসাদের এতো নিকটে গিয়ে কি রাজা রানীর কানের উপর মাইক লাগিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন সম্ভব?
হোয়াইট হাউসের আর্কিটেক্ট জেমস হোভানের জন্ম আয়ারল্যান্ডে ১৭৬২ সালে। হোবানের স্থাপত্যশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল আইরিশ এবং ইংলিশ জর্জিয়ান শৈলীর ঐতিহ্য। নিউক্লাসিক্যাল প্যালাভিয়ান এই কৌশল কার্যত আধুনিক নির্মাণ শৈলীর ভিত্তি দিয়েছে। একপর্যায়ে স্থাপত্যের আধুনিক ধারা নিউক্লাসিক্যাল ঘরানা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসে অথবা বলা চলে নিউ ক্লাসিক্যাল ঘরানার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে আধুনিক আর্কিট্রেকচারের যাত্রা শুরু।
হোয়াইট হাউসের নকশা প্রতিযোগীতায় হোবানের প্রস্তাবটি জর্জ ওয়াশিংটনের মনঃপূত হয়। ১৭৯৩ সালে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ১৮০০ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ভবনটির বর্হিদেশে ডাবলিনের লেইন স্টার হাউস এবং জেমস গিবসের আর্কিটেকচার প্লেট দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। হোবান ক্যাপিটল ভবন নির্মাণ কাজের সুপারিটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত থাকলেও অতি দক্ষতার ক্যাপিটলের নির্মাতা উইলিয়াম থর্নটনের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। লাফায়েট স্কয়ারের মুখোমুখি দাড়িয়ে থাকা হোয়াইট হাউসের অর্ধাচন্দ্রাকৃতির বারান্দার মাঝখানে সৃজিত অপূর্ব প্রাকৃতিক বিন্যাস আপনাকে মুগ্ধ করবেই। লাফায়েট স্কয়ারের রেলিং স্টোনে বসে ভাবছিলাম, আড়াইশো বছর আগে মার্কিন রাজনীতিকরা ভেবে রেখেছিলেন, শুধু আমেরিকাই নয় গোটা পৃথিবী থেকে বৃটিশদের বিতাড়িত করা হবে। হয়েছেও ঠিক তাই।
১৭৫৭ সালে সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে উপনিবেশ শাসনের সূত্রপাত ঘটায়। একই সময় আমেরিকা কানাডায় শুরু হয় বৃটিশ উচ্ছেদ অভিযান। ক্লাইভ ও হেস্টিংস বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনে ভারতবর্ষে যে সব অপকর্ম করেছিলেন, কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আড়াই’শ বছর পর ধরে এর’চে বেশী অন্যায় করে, আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীরা ঔপনিবেশিক শাসনের পথ প্রশস্থ করেছিল। ছোটবেলা থেকে দ্বীপ থেকে দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো ছিল কলম্বাসের নেশা। প্রাতিষ্ঠানিক খুব বেশী শিক্ষা না থাকলেও ক্রমশ একজন জ্ঞানী মানুষে পরিণত হন। ইউরোপ জুড়ে তখন মসলা ব্যবসার রমরমা অবস্থা। বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ঘানার মধ্যবর্তী দ্বীপ ভ্রমণের সময় মসলার খনি ভারতবর্ষ গমনের শর্টকাট রাস্তা বের করার স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন। প্রস্তাবটি রানী ইসাবেলা’র মনোপূত হয় এবং তাঁর অর্থায়নে শুরু হয় অভিযান। ১২ অক্টোবর জাহাজ নোঙ্গর করলো বাহামায়। অত:পর কিউবা, হিস্থানীওয়ালা ও হাইতি। বাস্তবতা হলো এসব দ্বীপে বাস করতো কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে থাকা কতগুলো সহজ, সরল আদিবাসী মানুষ। আগুন্তুক ইউরোপীদের দেখে এরা অবাক বিষ্ময়ে শুধু তাকিয়েই থাকতো।
শুধু লাঠিসোটা, পাথর আর গাছের ডাল দিয়ে প্রতিরোধ করলেও কলম্বাসদের আমেরিকায় কবর হতে পারতো। উল্টো ফেরার পথে বন্দী করে নিয়ে আসে কয়েক’শ রেড ইন্ডিয়ান। কলম্বাস এরপর আরো দু’বার আমেরিকায় অভিযান চালিয়েছিলেন সেগুলোও ছিল নিষ্ঠুরতায় ভরা। সাথে নিয়ে গেছেন কয়েক’শ করে ক্রীতদাস। মাত্র একশ বছরে বৃটিশ, ফরাসী, ইটালিয়ান আর স্প্যানিশরা গোটা আমেরিকা মহাদেশটাই দখল করে ফেলে। ষোড়শ শতকব্যাপী আমেরিকায় বিকশিত হওয়া সভ্যতা আসলে ইউরোপীয়ানদের আধুনিক আমেরিকা গড়ে তোলা। আজকের আমেরিকা গড়তে গিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে আদিম জনপদ, আদিম ভাষা ও আদিম সংস্কৃতি। পাঁচশ বছরের ব্যবধানে রেড ইন্ডিয়ান আদিম সংস্কৃতি বলতে আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আমেরিকা মহাদেশে রাস্তাঘাট, ব্রীজ, জাহাজ বলতে কিছুই ছিল না। বড়জোর কাঠের তক্তা বা কাঠের গুড়ি বা কলাগাছের ভেলা আর নৌকা। পুরো ষোড়শ শতক জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো একের পর এক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। স্থাপিত হতে থাকলো গোটা দেশব্যাপী রাজ্যের সব প্রশাসনিক দপ্তরের ক্লাসিকাল অফিস ভবন। এক শতকের ব্যবধানে আমেরিকা শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে যায়। সপ্তদশ শতকে অর্থাৎ অভিবাসী ইউরোপীয়ানদের তৃতীয় প্রজন্ম নিজেদের আমেরিকান পরিচয় দিতে উৎসাহী হয়ে উঠল। মাঠে মাঠে বিস্তীর্ণ ফসল, মাটির নীচে তেল সহ অফুরন্ত তেল ভান্ডার। নদী সাগরে সর্ববৃহৎ মৎস্যভান্ডার। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যায় বৃটিশ, ইটালিয়ান, ফরাসি ও স্প্যানিশরা। আমরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য করবো। বহুভাষিক আমেরিকানদের এই অনুভূতি জন্ম দিয়েছে এক বিচিত্র রাষ্ট্রের। নাম তার আমেরিকা। দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হোয়াইট হাউস। আমেরিকানরা মনে করে হোয়াইট হাউস হলো বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
বাস্তবতাও এর ব্যতিক্রম নয়। এক ডলারের দোর্দন্ড প্রতাপ থেকে বুঝা যায় পৃথিবীর কোন মুদ্রাই এটির ধারে কাছে ঘেঁষতে পারছেনা। আমেরিকান স্যাংশনে পড়ে ইরান রাশিয়ার মতো দেশের নাভিশ্বাস। হোয়াইট হাউস তেল আবিবের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। তেল সমৃদ্ধ গোটা মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান পলিসির কাছে অসহায়। হোয়াইট হাউস না চাইলে কেউ জাতিসংঘের মহাসচিব হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বলা হয়ে থাকে গোটা বিশ্বের সামরিক শক্তিকে একা চ্যালেঞ্জ করতে পারে আমেরিকা। আমেরিকান বিরোধীতার মুখে কারো পক্ষেই ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা ক্ষমতায় আরোহন হিমালয় লঙ্ঘনের চেয়ে কঠিন। মামুন গাড়ী স্টার্ট দিল নিউইয়র্কের পথে। বললাম, যদি সম্ভব হয় এই শ্বেত প্রাসাদ দেখতে আবার আসবো। বিশাল হাইওয়ে দিয়ে শ’মাইল গতির গাড়ীর ড্রাইভিং সীটে বসে মামুন বলছিল, শোন– এই ঝকঝকে মসৃন রাস্তা বল আর ক্লাসিকাল, নিউক্লাসিকাল আর আধুনিক দালান কোঠা যাই’ই বল, এর প্রতিটি ইট, মার্বেল আর পাথর কণায় মিশে আছে কালো মানুষগুলোর ফোটা ফোটা ঘাম আর সাদা চামড়ায় ইউরোপিয়ানদের নিষ্ঠুরতা আর নৃশংসতা।
লেখক : কলামিস্ট; আইনজীবী, আপীল বিভাগ।