ইতালির ইউরোর শিরোপা পুনরুদ্ধারের অপেক্ষাটা যেখানে ৫৩ বছরের সেখানে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় যেকোন ট্রফি জয়ের অপেক্ষাটা ৫৫ বছরের। ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর আর কোন ট্রফি জেতাতো দূরে থাক ফাইনালেও যেতে পারেনি। অপরদিকে চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা প্রথমবারের মতো ইউরোর শিরোপা জিতেছিল ১৯৬৮ সালে। দু দলের অপেক্ষাটা দু রকমের। এরই মধ্যে ৫৫ বছর পর প্রথমবারের মতো ইউরোর ফাইনালে গিয়ে শিরোপা জয়েরও স্বপ্ন দেখছিল ইংলিশরা। ‘ইটস কামিং টু হোম’ শিরোনামে দারুণ এক গান রচনা করে ফেলেছিল ইংলিশরা এই ভেবে যে প্রথমবারের মতো শিরোপা যাচ্ছে তাদের ঘরে। কিন্তু সে স্বপ্ন ভেঙে দিল ইতালি।
তাই গানের কথার সাথে যোগ হয়ে গেছে ‘নট ইন হোম ইটস গোয়িং টু রোম’। ইংল্যান্ডের ৫৫ বছরের অপেক্ষাকে আরো দীর্ঘায়িত করে ইতালি অবসান ঘটালো ৫৩ বছরের অপেক্ষার। ৬৫ হাজার দর্শকের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামসহ পুরো লন্ডনকে স্তব্দ করে দিয়ে ইউরোর স্বপ্নের ট্রফিটা রবার্তো মানচিনির শিষ্যরা নিয়ে গেল রোমে। শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়ে ইউরো জয়ের মধ্য দিয়ে গতবার বিশ্বকাপে খেলতে না পারার জ্বালাটা মেটাল আজ্জুরিরা। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ও ১-১ গোলে অমিমাংসিত ছিল ম্যাচটি। একই দিনে দুটি বৈশ্বয়িক টুর্নামেন্টের ফাইনাল। দিনের সকালে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা জয়ের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান হয়েছিল। কিন্তু মধ্যরাতে ইংলিশরা পারলনা ৫৫ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে। খেলোয়াড়ি জীবনে রবার্তো মানচিনি এবং গ্যারেথ সাউথগেট যা করতে পারেনি কোচ হিসেবে সেটা করার সুযোগ এসেছিল দুজনের সামনে। কিন্তু ইতালির কৌশলের কাছে মার খেতে হলো সাউথগেটকে। স্বপ্ন পূরণ করে ট্রফি নিয়ে রোমে ফিরলেন মানচিনি। গত রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলতে না পারার যে আগুনটা জ্বলছিল ইতালিয়ানদের মনের ভেতর সেই আগুনে যেন পুড়ে ছারখার হয়ে গেল ইংলিশরা। রোম যখন উৎসবে মাতোয়ারা লন্ডন তখন নিরব, নিথর। এ যেন মৃত্যুপুরি। ইউরোর ট্রফি জিততে না পারার শোকে যেন বিহবল ফুটবল পাগল ইংলিশরা। তাইতো খেলা শেষে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে ইংলিশ সমর্থকরা।
লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচের শুরুটা ছিল ইংল্যান্ডের। ঘড়িতে তখন দুই মিনিটও হয়নি। লুক শ এর গোলে উত্তাল হয়ে উঠে ওয়েম্বলি। অধিনায়ক হ্যারি কেইন কিছুটা এগিয়ে মাঝমাঠ থেকে দারুণ থ্রু পাস দিয়েছিলেন ট্রিপিয়ারকে। তিনি ক্রস বাড়ালেন বাঁ দিকে। সেখানে ফাঁকায় বল পেয়ে জোরালো শটে গোল করেন লুক শ। ইউরোর ইতিহাসে ফাইনালে এটাই সবচেয়ে দ্রুততম গোল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোল খেয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে ইতালি। পরে চেষ্টা করে খেলায় ফেরার। কিন্তু বারবার তাদের আক্রমণ গুলো প্রতিহত হচ্ছিল ইংলিশ রক্ষণ দেওয়ালে। ইংলিশরাও পাল্টা আক্রমণে যেতে থাকে। ফলে খেলায় গতি থাকলেও গোল করার সুযোগ আসেনি কারো সামনে। ফলে প্রথমার্ধে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় ইংলিশরা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে আক্রমণের ধার আরো বাড়ায় ইতালি। কিন্তু ইংলিশ গোল রক্ষক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে। তবে ৬৭ মিনিটে সমতায় ফেরে ইতালি। স্বাগতিকদের স্তব্ধ করে দেয় আজ্জুরিরা। কর্নার কিক থেকে উড়ে আসা বলে দারুণ হেড নিয়েছিলেন মার্কো ভেরাত্তি। তার হেড পিকফোর্ড পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে ছোট্ট টোকা দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন বোনুচ্চি। ইউরোর ফাইনালে সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল করলেন বোনুচ্চি। এখন তার বয়স ৩৪ বছর ৭১ দিন। গোল হজম করার পর খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে ইংল্যান্ড। যদিও নির্ধারিত ৯০ মিনিটের বাকি সময়ে ইতালির গোল পোস্টে কোনো শটই নিতে পারেনি। অতিরিক্ত সময়েও একইভাবে চলতে থাকে। ১০৩ মিনিটে ইতালির পক্ষে ব্যবধান গড়ে দিতে পারতেন বের্নারদেস্কি। বাঁ দিক থেকে ইনসিনিয়ের দারুণ ক্রসে পা ছোঁয়াতেই পারেননি বদলি নামা এই ফরোয়ার্ড। চার মিনিট পর বের্নারদেস্কির ফ্রি কিক দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ঠেকিয়ে ম্যাচ টাইব্রেকারে নিয়ে যান ইংলিশ গোল রক্ষক পিকফোর্ড। সেখানেও দারুণ পারফরম্যান্স দেখালেন তিনি। কিন্তু তারপরও হাসতে পারলেন না সতীর্থদের ব্যর্থতায়।
টাইব্রেকারের গল্পটা অনেকটাই নির্ধারিত সময়ের লড়াইয়ের মতো। ইংল্যান্ড প্রথম দুই শটেই গোল পায়। বিপরীতে ইতালির দ্বিতীয় শট নিতে আসা আন্দ্রেয়া বেলোত্তির প্রচেষ্টা রুখে দেন জর্ডান পিকফোর্ড। কিন্তু এরপর ইংল্যান্ড লক্ষ্যে পাঠাতে পারল না আর একটি শটও। ইতালির তিন ও চার নম্বর শটে জাল খুঁজে নেন বোনুচ্চি ও ফেদেরিকো বের্নারদেস্কি। জর্জিনিয়োর নেওয়া তাদের পঞ্চম শটও ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশ গোল রক্ষক পিকফোর্ড। তারপরও নায়ক হতে পারেননি তিনি। টাইব্রেকারের কথা ভেবে মার্কাস র্যাশফোর্ড ও জ্যাডন স্যানচোকে শেষ মুহূর্তে বদলি নামিয়েছিলেন ইংলিশ কোচ। দুজনেই হতাশ করেছেন। র্যাশফোর্ড মারেন পোস্টে আর স্যানচো ও বুকায়ো সাকার শট রুখে দেন ইতালিয়ান গোল রক্ষক দোন্নারুম্মা। ইউরোর ফাইনালে এই জয়ের মধ্য দিয়ে টানা ৩৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকল ইতালি। ১৯৬৮ সালের পর আবার ইউরোর শিরোপা জিতে নিল রবার্তো মানচিনির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া ইতালি। এই দলটি যেন হারতে ভুলে গেছে। আর সে পথ চলায় ইউরোপ সেরার ট্রফিটা রোমে নিয়ে গেল ইতালির ফুটবলাররা।