‘আমার মোটেই কোনো ধারণা ছিল না যে আমি একজন ফটোগ্রাফার হব কখনও। একজন ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জীবনে এটাই একমাত্র সময় ছিল, যখন আমার মা আমাকে কিছু করতে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি গভীর রাতের শিফটে ডাক্তারদের দেখেছিলেন এবং আমাকে সে ধরনের পেশায় রাখতে চাননি। বুঝতে পারেননি যে প্রেস ফটোগ্রাফি আরও খারাপ হবে!’ – হোমাই ভিরাওয়াল্লা
একসময় কলকাতার ফটোগ্রাফি স্টুডিওগুলোতে ইংরেজ ফটোগ্রাফারদেরই আধিক্য ছিল মূলত। পালকি চড়ে ছবি তুলতে আসতেন বাঙালি মহিলারা, অধিকাংশই ধনী পরিবারের, পালকি থাকতো আপাদমস্তক কাপড় দিয়ে মোড়ানো। সঙ্গে থাকতো তাদের দাসীরা। সে–সময়ে স্টুডিওর ভেতরে কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, আগে থেকেই ক্যামেরা লাইট ইত্যাদি রেডি থাকতো। ছবি তোলা শেষ হলেই ঝটপট আবার পালকিতে উঠে বিদায়। অনেক সময়ই ফটোগ্রাফারের কোনো মহিলা সহযোগী তাদের ফটো তুলে দিতেন।
এই সমস্যার সমাধানের জন্য বেশ ক’জন ইংরেজ নারী ফটোগ্রাফারের আগমন হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিসেস মেয়ার, মিসেস টি থমসন, মিসেস বি বি উইন্স এবং মিসেস সি বি ইয়ং। ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের তৃতীয় স্ত্রী মনমোহিনী দেবী মিসেস বিবি উইন্স এর কাছে ফটোগ্রাফির পাঠ নিয়েছিলেন। তিনি নাকি ডেভেলপও করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দীনি দেবীও ফটোগ্রাফি করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘ ‘যোগাযোগ’– এ সে–বিষয়ে বেশ কিছু রেফারেন্স আছে।
ফটোগ্রাফির চর্চা অনেকে করলেও ঊনবিংশ শতকে বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম পেশাদার ফটোগ্রাফি শুরু করেন সরোজিনী ঘোষ। সে–সময়ে অমৃতবাজার পত্রিকায় তাঁর স্টুডিওর বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ছিল দ্যা মহিলা আর্ট স্টুডিও এন্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর’। প্রসঙ্গত বলে রাখি, মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে প্রথম ফটোগ্রাফির চর্চা শুরু করেন এদেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার প্রয়াত সাইদা খানম। যে সময়ে মুসলিম পরিবারের নারীরা অনেকেই পড়ালেখার সুযোগও পেতেন না। ১৯৫৬ সালে বেগম পত্রিকার হয়ে পেশাদারী ফটোগ্রাফি শুরু করেন তিনি।
ব্রিটিশ উপনিবেশী শাসনব্যবস্থা থেকে দেশভাগ হয়ে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা লাভ– যার ক্যামেরার ঝলকানিতে এই পুরো ইতিহাস প্রামাণ্য–তথ্যচিত্র হিসেবে অমূল্য দলিল হয়ে আছে; তিনি হলেন ভারতের প্রথম নারী ফটো সাংবাদিক হোমাই ভিরাওয়াল্লা। আজও তিনি তাই উপমহাদেশের নারীমুক্তির এক উদাহরণ হয়ে আছেন। তিনি অনেক দিক থেকেই অগ্রগামী ছিলেন। কেবল ভারতের প্রথম মহিলা ফটোসাংবাদিকই নন, তাঁর কর্মজীবন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উৎখাতে ভূমিকা রেখেছে।
১৯১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর পশ্চিম ভারতের গুজরাটের ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ প্রভাবশালী পার্সি জনগোষ্ঠীর একটি পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। বাবা একটি যাযাবর যাত্রাদলের অভিনেতা হওয়ার সুবাদে শৈশবের বেশিরভাগ সময় দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। কিছুসময় পরে তার পরিবার স্থায়ীভাবে বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই)-এ চলে এলে প্রথমে সেখানে সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং পরে ‘জে জে স্কুল অফ আর্ট ’ কলেজে ভর্তি হন তিনি। কলেজে থাকাকালীন সময়ে মানেকশাহ ভীরাওয়াল্লা নামের টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফারের সাথে পরিচয় হয় তার। সেই সূত্রে মানেকশাহই প্রথম ক্যামেরার জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন হোমাইকে। প্রতিনিয়ত মুম্বাইয়ের অলিগলিতে ছবি তোলার নেশায় ঘুরে বেড়াতেন দুজন। সেখান থেকে সম্পর্ক প্রণয়ে গড়ালে পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। এর মাঝে কলেজে পড়ার সময়েই তার প্রথম কাজটা পেয়ে যান হোমাই– একটি পিকনিক দলের ছবি তুলে দেওয়ার কাজ নেন তিনি। তাঁর তোলা সেই ছবিগুলো স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপা হলে দ্রুতই বেশ কিছু বাড়তি কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি।
একসময় ‘ফটোগ্রাফস অফ লাইফ ইন মুম্বাই’ শিরোনামে তোলা তার কিছু ছবি ‘দ্যা ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’ এ প্রকাশিত হলে ব্যাপক পরিচিতি পান মিস ভীরাওয়াল্লা। স্বামী মানেকশাহ ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিস’ এর ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজের ডাক পেলে ভীরাওয়ালা দম্পতি ১৯৪২ সালে মুম্বাই থেকে দিল্লীতে চলে আসেন। সেখানে সার্বক্ষণিক সঙ্গী প্রিয় স্পিড গ্রাফিক ক্যামেরাটাকে পিঠে ঝুলিয়ে প্রায়ই দিল্লীর রাস্তায় সাইকেলে চরে ঘুরতে দেখা যেত তাকে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে যান হোমাই। তার সবচাইতে প্রশংসিত ঐতিহাসিক ছবিগুলো মূলত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় থেকেই তোলা। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তি লাভের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু’র শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মত বিয়োগাত্মক স্মৃতিবহ ছবি ছিল তার সংগ্রহে। এছাড়া লাল বাহাদুর শাস্ত্রীসহ, তিব্বতের দালাই লামাসহ আরো অনেক প্রখ্যাত নেতৃবৃন্দের ছবিও তুলেছিলেন তিনি। এমনকি স্বাধীনতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সময়ে ভারতের মাটিতে লর্ড মাউনব্যাটেন শেষ স্যালুট প্রদানের সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তটিকেও নিজের ক্যামেরায় বন্দী করেছিলেন তিনি।
তাঁর তোলা ছবিগুলি প্রথমে তাঁর স্বামীর নামে প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে একটি ছদ্মনাম তিনি নিজের জন্য ঠিক করেছিলেন, ‘ডালডা ১৩। জাতীয় সম্মান অর্জন করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। রলিফ্লেক্স ক্যামেরা হাতে একজন শাড়ি পরিহিত নারীকে তাঁর সমসাময়িক ফটোগ্রাফারেরা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি, এমনকি তাঁকে বাদ দেবার জন্যও অনেকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ঘটনাগুলির ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে জওহরলাল নেহরুর (তার প্রিয় বিষয়), মহাত্মা গান্ধীর ছবি এবং পরে ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনেক অকপট প্রতিকৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধারাবাহিকভাবে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ভারত সফরে আসা বিদেশি অনেক তারকা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবিও তুলেছিলেন। যেমন চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন, মহারাণী এলিজাবেথ দ্বিতীয় এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দের ছবি তোলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নেহেরুর ছবিই বেশি ছিল তাঁর সংগ্রহে, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিনে, নেহেরুই তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর বাকী আলোকচিত্রীদের কাছ থেকে মুখ ঢেকে কান্না করেছিলেন তিনি। আরেক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর পেশাজীবনের সবচেয়ে বড় অনুশোচনা হল যে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয় সেই সংলাপ অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত হতে না পারা। পারিবারিক কোন বিশেষ প্রয়োজনে সেদিন তিনি সেখানে যেতে পারেননি এবং একজন ভারতীয় হবার সাথে সাথে একজন ফটোগ্রাফার হিসেবেও এ–নিয়ে প্রচণ্ড দুঃখবোধ তাঁর।
তিনি তাঁর সময়ে ভারতে একমাত্র পেশাদার মহিলা ফটোসাংবাদিক ছিলেন এবং পুরুষ–শাসিত ক্ষেত্রে তাঁর বেঁচে থাকা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই পেশাটি আজও বেশিরভাগ নারীকে বাদ দিয়েই চলেছে। হাস্যকরভাবে, হেনরি কার্টিয়ের– ব্রেসোঁ এবং মার্গারেট বুর্ক হোয়াইটের মতো ভারত সফরকারী পশ্চিমা ফটোসাংবাদিকরা ভারতীয় সমসাময়িকদের চেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছেন। একজন নারী হিসেবে হোমাই ভ্যারাওয়াল্লার উপস্থিতি ছিল আরও বেশি প্রান্তিক।
হঠাৎ ১৯৬৯ সালে জীবনসঙ্গী মানেকশাহ ভিরাওয়াল্লার অকস্মাৎ মৃত্যু হলে দিল্লী ছেড়ে জন্মভূমি গুজরাটে ফিরে যান মিস হোমাই। প্রেস ফটোগ্রাফার হিসাবে হোমাই–এর কর্মজীবন ১৯৭০ সালে সমাপ্ত হয়। তখন বিশ্ব পরিবর্তিত হয়েছিল এবং তিনি এই পরিবর্তনকে অনুপ্রাণিত করতে এবং রেকর্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১০১১ সালে, তাঁর মৃত্যুর আগের বছর, হোমাই ভিরাওয়াল্লা ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন।