‘হে সখা, মম হৃদয়ে রহো।
সংসারে সর্বকাজে ধ্যানে জ্ঞানে হৃদয়ে রহো’
গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার ২২ শে শ্রাবণ ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। প্রতি বছরই ২২শে শ্রাবণ আসলে আমরা পরম শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি। তবে এই বছর অর্থাৎ গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার ছিল ২২শে শ্রাবণ। সেদিন আমাদের জাতীয় জীবন ছিল চরম এক সংকটের মুখে। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে কবিগুরুকে নিয়ে লেখার মানসিকতা ছিল না। পুরো দেশ জাতি সেদিন এক জাতীয় সংকটে পড়ে বুঝতেই পারছিলাম না দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কোন পথে এগুচ্ছে। দেশের এমন ক্রান্তিকালেও কিন্তু বার বার কবির গান ও বাণী শুনে মনকে হালকা রাখার চেষ্টায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল, দেশের আপামর জনসাধারণ একই সুরে গাইতে থাকি ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা/ কহো কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা’। একইভাবে অতিমারীর সময়েও আমরা ২৫শে বৈশাখ অতিক্রম করেছিলাম, কোনো উৎসব আর উদযাপনের সুযোগ ছিল না। তবে তথ্য প্রযুক্তির মুক্ত প্রবাহের ফলে অনেকেই অনলাইনে, ফেসুবকে, টুইটারে কবিগুরুকে স্মরণ করেছিল গভীর শ্রদ্ধায়, অপার ভালোবাসায়। ২২ শে শ্রাবণ, তো বর্ষাকালেই আসে। আর বর্ষা কবির প্রিয় ঋতুর এক অন্যতম ঋতু। আর এই প্রিয় ঋতুতেই কবি ৮০ বছর বয়সে যাত্রা করেছিলেন অনন্তলোকে। বৈশাখের তপ্ত দহনে যিনি পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, ঘনঘোর বরষার অঝোর বর্ষনে তিনি বিশ্ববাসীকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়ে শেষ গানটির রেশ নিয়ে শেষ কথাটি বলেই চিরবিদায় নিলে ধীরে ধীরে। চলে গেলেন অমর্ত্যলোকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ২২ শে শ্রাবণের দিনেই। মৃত্যু কবির কাছে গীতিসুধারসে আসেনি। জগতের যাবতীয় মাধুরী অন্তরের মাধুরীতে পরিপূর্ণ ছিল। শারীরিকভাবে তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। এই চলে যাবার কষ্টের মাঝেও তিনি ছড়িয়ে গেছেন অমৃত রসের করুণাধারা। মৃত্যুর সাতদিন আগেও তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল । লিখেছিলেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক আদর্শের বিশাল এক অংশ জুড়ে ছিল শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। অথচ তাঁর হাতে তখন অর্থঘাটতি ছিল। অর্থ সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সমস্ত অর্থ তিনি এখানেই ঢেলে দিয়েছিলেন। পরে তিনি মৃণালিনী দেবীর গহনা পর্যন্ত বিক্রি করে এই নির্মাণকাজে খরচ করেছিলেন। চার দেয়ালের বন্দী কক্ষে পাঠদানে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর চিন্তার পাঠশালার ছাদ হবে খোলা আকাশ, গাছপালা পত্রপল্লব হবে দেয়াল, মুক্ত হাওয়া আর খোলা অঙ্গন হবে পাঠশালার স্থাপনা। কবি আজীবন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পূজারী ছিলেন। তাই জোঁড়াসাঁকোর জমিদার বাড়ি ছেড়ে বোলপুরে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশপাশি কবি সাহিত্য , সমাজ, রাষ্ট্র , অর্থনীতি তথা যাবতীয় ইতিবাচক ও কল্যাণমনস্ক চিন্তাচেতনাকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন। আমৃত্যু কল্যাণ ও শান্তির পূজারী কবি সদা জগৎ ও জীবনের ইতিবাচক দিককে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি তাই বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারানো পাপ’। মানুষের সুখ দুঃখ বিরহ কান্না কবির মানসচেতনাকে অনবরত দোলায়িত করতো। আর সব চিন্তা আর চেতনার সার্থক বহিঃপ্রকাশ আমরা তাঁর সমগ্র সাহিত্য কর্মজুড়ে প্রত্যক্ষ করি। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার লিখেছিলেন: ‘শান্তিনিকেতনে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসকরা বলেন, অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ৯ শ্রাবণ কবিকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো।
সেটিই ছিল শান্তিনিকেতন থেকে কবির শেষ যাত্রা। ১৪ শ্রাবণ কবির অস্ত্রোপচার হলো। সফল হলো না। অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। তিনি জ্ঞান হারালেন। শেষ নিঃশ্বাস পড়লো, রাখী পূর্ণিমার দিনে মধ্যাহ্ণে। বাংলা ১৩৪৮ সালে ২২ শে শ্রাবণ ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৬ আগস্ট। বিশ্বকবি চলে গেলেন অমৃতলোকে। সেদিনই সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে ভাষণ দেন জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেছিলেন, ‘রবি আজ ডুবে গেলো। এ রবি আর উঠবে না। কেবল কি আজ বাংলা আঁধার হয়েছে : না, সারা ভারতবর্ষও না, সারা বিশ্ব আজ আঁধার হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ অমর কবি। তিনি অমরধামে গিয়েছেন। মরণ তাঁহার কাছে ভয়ানক ছিল না। পরম বন্ধুর মতো তিনি ভানুসিংহ ঠাকুরের ভণিতায় মরণরে সম্ভোধন করে বলেছিলেন : ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান ”। আবার ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
জীবদ্দশায় পরিবারে কবি ৪০টি মৃত্যু দেখেছিলেন। তাই মৃত্যুচিন্তা তাঁর সৃষ্টিতে নানাভাবে এসেছে। ভরা যৌবনেও কবি বলেছিলেন ‘…তবে যাও কবি, অমর ধামে, যেখানে পূর্ণ সৌন্দর্য, পূর্ণ আনন্দ, পূর্ণ প্রেম নিত্য বিরাজ করে সেই শাশ্বত ধামে।’