ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি… কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের চরণেই প্রকাশ পায়, আমাদের গ্রাম বাংলার পরতে পরতে হেমন্তের কী অপরূপ রূপ। ঋতুচক্রের দোলায় চড়ে প্রকৃতিতে আসে স্বর্ণঋতু হেমন্ত। হেমন্তকে তত বেশি ধরা ছোঁয়া না গেলেও দারুণভাবে অনুভব করা যায়। এ ঋতুতে গ্রীষ্মের উত্তাপ নেই, শীতের তীব্রতা নেই। হেমন্তের এই সময়ে উঠোন মাঠ ভরে ওঠে সোনালি ফসলে। ধানের ঘ্রাণে কৃষাণীর চোখে মুখে হাসির ঝলকানি দেখা দেয়। বাংলার এমন রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ নানাভাবে হেমন্তকে আবেদনময় করে বলেছেন, আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়… কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে…। এমন মিষ্টতা ভরা হেমন্ত সব সময় তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এ সময় শিশির কণায় সবুজ প্রকৃতি হয়ে ওঠে অলঙ্কারময়। বিশাল মাঠজুড়ে সোনালি ধানের দোলা পুলকিত করে মন। লতা– পাতা– ঘাস আর কাশফুলে শিশির বিন্দুর অপরূপ দৃশ্যে জানান দেয়, কনকনে শীত দুয়ারে সমাগত। গ্রাম বাংলায় হেমন্ত ধরা দেয় উৎসবের আমেজ ও প্রাণের উচ্ছ্বাসে। কৃষকের ঘরে ঘরে শুরু হয় বাংলার ঐতিহ্য ‘নবান্ন উৎসব’। নতুন ধানের চাল দিয়ে ঘরে ঘরে ফিরনি পায়েস বানানোর নানা আয়োজন। ধুম চলে বাহারি পিঠা বানানোর। এ সময়ে ঢেঁকিতে কৃষাণীরা দল বেঁধে চাল গুঁড়ো করতে ব্যস্ত থাকে আর কৃষকেরা খুশিমনে খেজুর রস সংগ্রহ করে। এই নবান্নকে উৎসবমুখর করে তুলে গ্রাম্য মেলা। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়া, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ সবকিছুর আয়োজন থাকে গ্রামের এ মেলায়। সাথে থাকে দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কালের যাত্রায় হেমন্তে গ্রাম বাংলার উপভোগ্য মুহূর্ত ও নবান্নের আমেজ যেন দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক কোলাহলে গ্রাম বাংলার হেমন্তের রূপ বৈচিত্র্য ও প্রাণের উল্লাস শহরের মানুষের কাছে স্পর্শ করতে পারে না। নবান্ন উৎসব, গ্রাম্য মেলা, পিঠা পুলির আয়োজন, দেশীয় খেলা আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের সন্তানদের অনেকেই এসবের সাথে পরিচিত নয়। গ্রাম বাংলার এ চিরন্তন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আমাদেরই ধরে রাখতে হবে। তাহলে আধুনিকতার সর্বনাশা স্রোতে আমাদের সন্তানরা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না।