হৃৎপিণ্ড ও হৃদরোগ : মিশরের মমি থেকে কায়রোকার্ডিও-২০২৫

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | শনিবার , ৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্স যৌথভাবে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি এবং অ্যামেরিকান সোসাইটি অব নিউক্লিয়ার কার্ডিওলজি ও ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন আয়োজন করে। অধিকাংশ হোরাস পরীক্ষা কায়রো পুরোকীর্তি জাদুঘরে সম্পাদিত হয়। প্রসঙ্গত, প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিজ্ঞানে হোরাসকে যুদ্ধ ও আকাশের দেবতা মনে করা হতো। তিনি ছিলেন মিশর রাজতন্ত্রের ত্রাণকর্তা। তাকে আপার ও লোয়ার মিশরের সংযোগ স্থাপনকারী বলে বিশ্বাস করা হতো। হোরাস সূর্য ‘রা’ এর সাথে মিলে সূর্যের দেবতা রূপে পরে আবির্ভূত হয়। হোরাস এর চোখ প্রসিদ্ধ মিসরীয় প্রতীক। তা সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাময়েরও প্রতীক। হোরাস সমীক্ষার অনুরূপ ফলাফল আরো কিছু অনুসন্ধানী গবেষণায় পাওয়া যায়। আমেরিকা ও মিসরের বিশেষজ্ঞগণ কায়রো জাদুঘরের বেসমেন্টে রক্ষিত মমি ও তার দেহাবশেষ পরীক্ষা করে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালী শনাক্ত করেন। তার মধ্যে ১৬টিতে করোনারী রক্তনালীর ব্লক দেখতে পান। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মমিটি ছিল মিসরের রানী অ্যামোস নেফারতিতির পরিচারিকা লেডি রাই এর। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৩০৪০ বছর। খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে রাজা টুটেনখামেনে এর শাসনের ২০০ বছর আগে তিনি মারা যান। এই গবেষণার ফলাফল অরল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সে উপস্থাপিত হয়। মমি ছাড়াও এই যাদুঘরে অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে ফেরাউন মেরেন্‌থা এর হাড় পোড়াসহ দেহাবশেষ রক্ষিত আছে। তা দর্শনে জনৈক গবেষক কৌতুহলী হন। এই ফেরাউন ১২০৩ সালে রক্তনালীর রোগে মারা যান। যখন তার বয়স ছিল ৬০ বছর। যুক্তরাজ্যের লিড্‌স মিউজিয়ামে রক্ষিত মধ্য বয়সে মারা যাওয়া জনৈক ধর্ম যাজকের মমিতেও (কফিনে তার নাম ও পরিচিতি লেখা ছিল) অনুরূপ পরিবর্তন পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে ম্যানচেস্টার ইজিপাশিয়ান প্রজেক্ট এর পৃষ্ঠপোষকতায় তার পরীক্ষা করা হয়েছিল। এভাবে করোনারী হৃদরোগ উৎপত্তির ইতিবৃত্ত তথা রোগতত্ত্ব উন্মোচিত হয়।

কায়রো কার্ডিও ২০২৫

মমিতে সংরক্ষিত হৃদপিণ্ড ও পরবর্তীতে এতে হৃদরোগের উপস্থিতি সনাক্তের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ও তার ধারাবাহিকতায় মিশরের রাজধানী কায়রোতে ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইজিপশিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি। বর্তমানে তার সদস্য সংখ্য ৪০০০। এই সংগঠন মিশর ও মধ্য প্রাচ্যের হৃদরোগের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করে। এর উদ্যোগে গত ২৫২৮ ফেব্রয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ৫২তম কায়রোকার্ডিও ২৫ শীর্ষক আন্তজার্তিক কনফারেন্স। মিশরের রাজধানী কায়রোর ৭ তারকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তা আয়োজিত হয়। কায়রো আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ এবং মধ্য প্রাচ্যের সর্ববৃহৎ নগরী। তা প্রাচীন মিশরের সাক্ষ্যবহনকারী। বিশ্ববিখ্যাত গিজা পিরামিড এবং প্রাচীন মেমফিস নগরী কায়রোতে অবস্থিত। আমি চট্টগ্রামের ‘খাদ্যভ্যাস ও হার্ট অ্যাটাকের বুঁকি’ শীর্ষক গবেষণা উক্ত কনফারেন্সে উপস্থাপন করি। ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে আমরা একদল হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অ্যামিরেটস বিমানে মিশর রওনা হই। আমাদের সফর সূচিতে ছিল প্রথমে লুক্সর নগরী ভ্রমণ শেষে কায়রো কনফারেন্সে যোগদান। আমরা ২২ ফেব্রুয়ারি কায়রো হয়ে লুক্সর পৌঁছি। লুস্কর প্রচীন মিশরের রাজধানী (প্রাচীন নাম থিবিস)। বর্তমান কালে লুক্সরকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত মিউজিয়াম। এখানে আছে বিখ্যাত স্মৃতিশোধ ‘রাজাদের উপত্যকা’ (ভ্যানিলা অব কিংস), অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি, লুক্সর, করনাক মন্দির ও আরো অসংখ্য প্রাগৌতিহাসিক স্থাপনা। লুক্সরে আমরা উঠি জলি ভলি নামের রিসোর্টে। নীল নদের পাড়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এই রিসোর্ট এর অবস্থান। সবুজ শ্যামল দূষণমুক্ত পরিবেশ, পাশে প্রবাহমান নীলনদের স্বচ্ছ জলরাশি ও তার মন জুড়ানো মৃদু হাওয়া। এক নৈস্বর্গিক পরিবেশ।

অন্যান্য স্থাপনা যেমন লুক্সর ও করনাক মন্দির নীল নদের পূর্ব পাড়ে। লুক্সর মন্দির খৃস্টপূর্ব ১৪০০ সালে নির্মিত। তবে করনাক মন্দির আরো প্রাচীন। তা মিশরের সর্ববৃহৎ মন্দির। লুঙর মন্দির সূর্য দেবতা ‘অমুন রা’ কে উৎসর্গীকৃত। লুক্সর ও করনাক মন্দিরে অসংখ্য স্তম্ভ ও মূর্তির সাথে রয়েছে সুউচ্চ সরু চতুস্কোন স্তম্ভ (ওবেলিস্ক), যা নির্মিত হয়েছিল সূর্য দেবতার প্রতি প্রদ্ধা প্রদর্শনে। দীর্ঘ পাতলা এসব স্তম্ভের শীর্ষদেশ পিরামিডের মতো তীক্ষ্ণ। গ্রীক ভাষায় ওবেলিস্ক মানে সূচ। লুঙর মন্দিরের প্রবেশ পথের একটা ওবেলিস্ক প্যারিসের লুবর মিউজিয়ামে স্থাপিত আছে। তেমনি ওবেলস্কি নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে এবং লন্ডনেও স্থাপিত আছে। মিসরের সবচেয়ে প্রভাবশালী রানী ক্লিওপেট্রার নামে তার নাম ‘ক্লিওপেট্রা সূচ’। ফেরাউন ২য় রামসেস মন্দিরসহ মিশরের সর্বত্র নিজের স্মৃতিস্তম্ভ দিয়ে ছেয়ে ফেলে ছিলেন। পাশাপাশি ওবেলিস্কগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধি করেন। গ্রিক কবি হোমার গ্রীকবীর একিলিস ও ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে তার রচিত ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যে লুঙর এর উল্লেখ করেন।

লুঙর ভ্রমণ শেষে এবার কায়রো ফেরা। ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে কায়রো পৌঁছে আমরা উঠি পাঁচ তারকা হোটেল হিলটনে। তবে কনফারেন্স ভেনু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। দুটো হোটেলই নিউ কায়রোতে এবং নীল নদের সন্নিকটে। বস্তুত এখানকার সব বড় বড় স্থাপনা নদী নদকে ঘিরেই। ‘মিশর নীল নদের দান’এই প্রবাদ সর্বজনীন। কনফারেন্সে আমার উপস্থাপনা ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে। আমরা ২৬ ফেব্রুয়ারি কনফারেন্স ভেন্যুতে পৌঁছে কিট সংগ্রহ করি ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সারি। কিছু সময় তথায় বৈজ্ঞানিক অধিবেশন উপভোগ করি। তারপর আমরা বেড়িয়ে পড়ি পিরামিড দর্শনে। কায়রোর শহরতলী গিজা নামকস্থানে এই ঐতিহাসিক পিরামিড কমপ্লেক্স। আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক রয়েছেন মিসরীয় গাইড মিঃ আশরাফ ও তার সহকারীগণ। মিঃ আশরাফের আন্তরিকতা পূর্ণ বিশুদ্ধ বাংলায় উচ্চারিত আহবান– ‘আসেন’ ‘আসেন’ এর সবাই উজ্জীবিত হই। সেদিন সন্ধ্যায় গালা ডিনার। কনফারেন্সে উপস্থাপক হবার সুবাদে ফ্যাকাল্টি হিসাবে আমার তথায় আমন্ত্রণ। এবার আমি দলছুট। একাই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এই ডিনারে উপস্থিত হই। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট জনদের, বক্তৃতা, সম্মাননা, সঙ্গীত ও নৃত্য সবই অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত একজনও আমার পূর্ব পরিচিত নন। আমার জন্য নির্ধারিত আসনের পাশে উপবিষ্ট মিসরীয় হৃদরোগ চিকিৎসক ডা: দীনা ও ডা: ইমাম দারাজকে তা বলাতে উনারা সানন্দে আমার সাথে পরিচিত হন। এবার ডিনারের পরিবেশনা শুরু। খাবার টেবিলে মিসরের ঐতিহ্যবাহী খেজুর দেওয়া আছে আগে থেকে। তারপর প্লেটে করে পরিবেশিত হলো আস্ত এক টুকরা মাংস। আমি অপেক্ষায় আছি পরের খাবার কী আসে তা দেখতে। এবার আসল চকলেটে আবৃত একই ধরনের আইটেম। আবার অপেক্ষার পালা। পাশে উপবিষ্টগণ আমাকে খাবার শুরু করতে আহবান করলে আমি বললাম আমি নিরামিষ ভোজী (অন্তত সে সময়টুকুর জন্য)। এতে পরিবেশনকারী দৌড়ে এসে আমার জন্য নিরামিষ প্লেট নিয়ে আসে। তাতে যৎ সামান্য খাবার। যা হোক গালা ডিনারে মন ভরলো। কিন্তু উদরপূর্তি হলো না। অনেকটা ক্ষুধা নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে কার যোগে আবার আবাসস্থল হোটেল হিলটনে পৌঁছাই। মিসরের সেই অচেনা পরিবেশে একাকী নির্বিঘ্নে পৌঁছাতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচি। ডিনারে পরিবেশিত খাবার ছিল পুরোটাই রেডমিট। আমি উপলব্ধি করি প্রাচীন মিশরীয়দের খাবারের অভ্যাসের সাথে আধুনিক মিসরীয়দের অভ্যাস অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরদিনই আমার উপস্থাপনা। রুমে ফিরে একটু রিহার্সসেল করি একা একা। পরদিন আমাদের টিমের সবাই যথা সময়ে উপস্থিত হই। উপস্থাপনা এক্সিভিশন এরিয়াতে। এতে মিশরীয় দুই সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারী উপস্থিত। আমি ‘চট্টগ্রামের খাদ্যভ্যাস ও হার্ট অ্যাট্যাকের ঝুঁকি শীর্ষক’ গবেষণা উপস্থাপন করি। এতে হার্ট অ্যাটাক সৃষ্টিতে চট্টগ্রামের খাদ্যভ্যাস তথা উচ্চ চবিযুক্ত মাংস, কম মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ দায়ী বলে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপিত হয়। কায়রো কনফারেন্স কমিটি এই গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করে। তা ভবিষ্যতে হৃদরোগ প্রতিরোধে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করে। উপস্থাপনা শেষে আমরা ছুটলাম কায়রো মিউজিয়াম দর্শনে। এখানেই রক্ষিত আছে মমি ও এতদ সম্পর্কীয় ও প্রত্নত্মাত্ত্বিক গুরুত্ববাহী বিভিন্ন উপাদান। কবি নজরুল ও হুইটম্যান বর্ণিত মানব দেহকে অতি পবিত্র জ্ঞান করে তা প্রদর্শিত হচ্ছে এই মিউজিয়ামে। তা শেষ করে আমরা সেদিন সন্ধ্যায় নীল নদের নৌবিহারে যোগদান করি।

উপসংহার

মিশরের লুক্সর আর কায়রো ভ্রমণে আয়োজিত এই কনফারেন্সে যোগ দিয়ে মিশরের নীলনদ, প্রাগৌতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন ও উপভোগ ছাড়াও তা হৃদরোগের কারণগত দিক উন্মোচন ও খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমরা আমিরাত বিমানে দুবাই হয়ে দেশে ফিরে আসি।

লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন। সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধ১১৭ বছরের পুরনো তামাদি আইন যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে