ভূমিকা : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘মানুষ’ কবিতায় বলেছেন, “তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয় ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।” একইভাবে প্রভাবশালী মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান লিখেছেন “If anything is sacred, the human body is scered” (ভাবার্থ : যদি পৃথিবীতে কোন জিনিস পবিত্র হয়ে থাকে তা হলো মানুষের দেহই সবচেয়ে পবিত্র)। প্রাচীন মিশরীয়গণ মানব দেহকে পবিত্র জ্ঞান করতেন। তা তাদের জীবদ্দশায় এবং মরনোত্তর সময়ে। তারা উপলব্ধি করেন মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুতে এই পবিত্র দেহও বিলীন হয়। আবার প্রাচীন মিশরের শাসক ফেরাউনদের অধিকাংশই ছিলেন স্বল্পায়ু। তাদের মধ্যে একমাত্র ২য় রামসেস ৯০ বছর বেঁচে ছিলেন। তাই তদানিন্তন রাজা, রানী, রাজ পরিবারের সদস্যদের, এমনকি মন্দিরের পুরোহিতদের মৃত্যুর পর তাদের দেহ পবিত্রজ্ঞান করে তা সমাধিস্থল করা হতো। এই ক্ষয়িঞ্চু পবিত্র দেহের দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে অনেকদিন ধরে। তারই ফলশ্রুতিতে তাদের দেহকে মমিতে রূপান্তরের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ফেরাউনের স্বল্পায়ু হবার কারণ সম্ভবত হৃদরোগ, যা পরবর্তীকালে তাদের মমির অনেকগুলোতে শনাক্ত করা হয়।
হৃদপিণ্ড ও প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান : প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই হচ্ছে এবার্স প্যাপিরাস। তা খৃষ্টপূর্ব ১৫৫০ সালে লিখিত। ১৮৭৩–৭৪ সালে তা মিশরের লুক্সর থেকে কিনে নিয়ে যান জার্মান মিশরতত্ত্ববিদ ইবার্স। তা বর্তমানে জার্মানীর লিপ্জিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে। এই বইয়ে হৃদপিণ্ড নিয়ে লেখা নিবদ্ধে হৃৎপিণ্ডকে অসাধারণ নির্ভুলভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এখানেই সর্বপ্রথম শরীরে নাড়ির গুরুত্ব এবং হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের সাথে তার সম্পর্ক বর্ণিত হয়। এই বইয়ে হার্ট ফেইলিউরের বর্ণনাও পাওয়া যায়। এতে আছে “চ্যানেল থিওরী”(channel theory) যা দেখিয়েছি যে সুস্বাস্থ্যের জন্য মানব দেহে তরলের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ বজায় রাখা জরুরী। এভাবে ইবারস প্যাপিরাস ইতিহাসে হৃদরোগের প্রথম পরিচিতি প্রকাশনা। তা হৃদরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এবং তৎকালীন ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকার সমস্ত সভ্যতাকে প্রভাবিত করে। উল্লেখ্য, প্রাচীনকালে মিশরীয়রা হৃদপিণ্ডকে শরীরের কেন্দ্রিয় চালিকা শক্তি (বা মোটর) এবং বৃদ্ধিমত্তার স্থান হিসাবে বিবেচনা করতো। হৃদপিণ্ডকে তারা আত্মার আশ্রয়স্থল জ্ঞান করতো। তা তাদের কাছে ছিল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। সেই কারণে মমি তৈরীতে তা সাবধানে অক্ষত রেখে দিত। যাতে তা সেই ব্যক্তির পরবর্তী জীবনের চিরস্থায়ী নিশ্চয়তা দান করে।
মমি ও হৃদরোগ : ১৯৪৮ সালে কার্ল রিচার্ড নেপসিন্স নামে একজন জার্মান মিশর তত্ত্ববিদ মিশরের রাজা ও পুরোহিতদের প্রাচীন সমাধি থেকে লুট হওয়া এক দলিল প্রকাশ করেন ‘দ্যা বুক অব ডেড’ নামে। এতে ছিল মৃতদেহ সংরক্ষণের নির্দেশাবলী। নির্দেশমতে দেহের মস্তিস্ক ও অন্যান্য আভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তথা লিভার, কিডনী, পাকস্থলী, অন্ত্র বের করে নিয়ে আলাদা পাত্রে রাখা হতো। কারণ এগুলোতেই পচন দরে প্রথম। তবে দেহের কেন্দ্র ও আত্মার আশ্রয়স্থল হিসাবে হৃৎপিণ্ডকে যথাস্থানে রেখে দেয়া হতো। তারপর দেহ বিশেষ ধরনের কেমিকেলে ডুবিয়ে ব্যান্ডেজে জড়িয়ে তার উপর পিচ্ প্রলেপ মাখিয়ে আর্দ্রতা রোধ করা হতো। এভাবে সংরক্ষিত দেহই ‘মমি’।‘মমি’ ফার্সি শব্দ। খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দিতে পারসিকরা মিশর শাসন করে। মমি তৈরীতে প্রমাণ হয় প্রাচীন মিশরীয়দের কেমিষ্ট্রির জ্ঞান ছিল। ‘খেম’ (khem) প্রাচীন মিশরীয় নাম। এ থেকে কেমিষ্ট্রি শব্দের উৎপত্তি বলে ধারনা করা হয়। ‘দ্যা বুক অব ডেড’ এ মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে, যা শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হলে মৃত্যুর পর আত্মার অবিনাশ নিশ্চিত হয়। এতে মৃত ব্যক্তি নিরাপদে বিচারগৃহ অতিক্রম করতে পারে। তার পাশাপাশি মমিতে রেখে দেওয়া হৃদপিণ্ড, যাকে বুদ্ধি ও ন্যায়ের কেন্দ্রস্থল হিসাবে মান্য করা হতো তা মৃত ব্যক্তির পক্ষে উপযুক্ত সাক্ষ্যদান করবে। এভাবে মৃতদেহ নিরাপদে বিচারগৃহ অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। পাপমুক্ত হয়ে অনন্ত সুখের রাজ্যে প্রবেশ করে দেবতা অসিরিসের (প্রাচীন মিশরীয় দেবতা) সাথে অনন্তকাল বসবাসের সুযোগ লাভ করবে। তবে পরকালে সুখ ভোগে সশরীরে উপস্থিতি আবশ্যক। তার জন্যই মৃত্যু পরবর্তী শরীরকে মমি তৈরী করে রাখার ব্যবস্থা। অবশ্য তার সম্ভব্যতা দেখা দিয়েছিল মিশরের শুষ্ক ভূমির কারণে, যেখানে মৃতদেহ ধীরলয়ে ক্ষয় হতো এবং দীর্ঘদিন শরীরের অবয়ব বজায় থাকতো। প্রাচীন মিশরের রাজাদেরকে মমি করে রাখা হতো তাদের নির্মিত বিপুলায়তনের সমাধি সৌধে। তা বিশ্বের বিস্ময়রূপে এখনও টিকে আছে পৃথিবীর বুকে। এটাই মিশরের আইকন তথা সার্বিক পরিচিতি। তা নির্মানের প্রায় ২ হাজার বছর পর গ্রীকরা মিশরে প্রবেশ করে এবং তার নামাকরণ করে ‘পিরামিড’। এখানে ৮০টার মতো পিরামিড এখনও টিকে আছে। এগুলোর মধ্যে কায়রোর শহরতলিতে গীর্জার বিশাল পিরামিড ১৩ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। তা পৃথিবীর অনন্য স্থাপত্য কীর্তি যা সাড়ে চার হাজার বছর পরও অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। গ্রীকরা পিরামিডকে বিশ্বের সাতটি আশ্চার্যের অন্যতম বলে মনে করতো। তাদের তালিকাভূক্ত আশ্চর্য্যের মধ্যে একমাত্র পিরামিডই আজ অবধি টিকে আছে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন রাজা ও দেবতাকে তুষ্ট করতে প্রণোদিত হয়ে এক লক্ষ লোক ২০ বছরে বিশাল এই পিরামিড তৈরী করে। মমির সাথে তাদের ব্যবহার্য জিনিস, অলংকার, চাকর বাকরদের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, খাদ্য, পানীয় রেখে দেয়া হতো। পিরামিড নির্মিত হতো রাজার মমিকৃত মৃতদেহ ও সম্পদ রক্ষার্থে। সূর্য দেবতাকে উদ্দেশ্য করে তার সুউচ্চ চূড়া নির্মাণ করা হতো। তবে আধুনিক কালের পর্যবেক্ষকগণ পিরামিডের কেন্দ্রে পৌঁছে শূণ্য শবাধার ছাড়া অন্য কিছু পাননি। মিশরের ৪র্থ রাজবংশের রাজা খুপুর তৈরী বিশাল পিরামিডের পাশে আরো দুটো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার পিরামিড তার উত্তরাধিকার খাফ্রে ও মেনকুরের। খাফ্রের পিরামিডের ১২০০ ফুট দূরে রয়েছে বিশাল এক শায়িত সিংহ মূর্তি। সিংহের শরীরে মানব মস্তক স্থাপিত এক দানবীয় কল্পরূপ এইটি। মূর্তিটি রাজার প্রতিবিম্ব ও তার ক্ষমতা আর গৌরবের রূপায়ন। গ্রীকরা তার নামকরণ করেন ‘স্ফিংস’(অর্থ শ্বাসরোধী), যা প্রকৃতপক্ষে অমঙ্গলের প্রতীক। কোন মানুষ রহস্যজনক আচরণ করলে বলা হয় সে স্ফিংস এর মতো ব্যবহার করছে। এটিই মিশরের সবচেয়ে বড় স্ফিংস।
বর্তমানে লুক্সরের ‘ভ্যালী অব কিংস’ (যেখানে মমি প্রথম পাওয়া যায়) কিংবা পিরামিডে (যেখানে তা স্থাপন করা হয়) কোন মমি নেই। অধিকাংশ মমি বর্তমানে ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে। এখানেই ফেরাউনদের মমি যেমন টুটেনখামুন, হাটসেফস্যুট, ২য় রামসেস সহ অন্যান্য মমির অবস্থান। কিছু মমি ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ইজিপশিয়ান সিভিলাইজেশন এ নিয়ে যাওয়া হয়। লুক্সর মিউজিয়ামেও কিছু পুরোহিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তির মমি রয়েছে। কিছু মমি লন্ডন মিউজিয়ামে, প্যারিসের লুবর মিউজিয়ামে, আমেরিকার নিউইয়র্ক ও শিকাগোতে রয়েছে। সর্বত্র মানব দেহের পবিত্রতাকে সম্মান প্রদর্শন করে তা সংরক্ষিত। যুগোপযোগী সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
মমির প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের পাশাপাশি রোগতত্ত্বীয় গুরুত্বও রয়েছে। তাতে হৃদরোগের রোগতত্ত্বীয় দিকও উন্মোচিত হয়েছে। ২০১১ সালের ১৭ মে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিশ্বের প্রথম করোনারী হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তি একজন প্রাচীন মিশরীয় রাজকন্যা। তার নাম আমোস মেরী আমন। তিনি খৃষ্টপূর্ব ১৫৮০–১৫৫০ সালে মিশরের লুক্সরে বসবাস করতেন। বিশ্বখ্যাত ‘হোরাস সমীক্ষা’ এই তথ্য প্রকাশ করে। এই সমীক্ষায় প্রাচীন মিশরীয়দের মমিতে হৃদপিণ্ডের রক্তনালীর ব্লকেড তথা অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস এর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করা হয়। এতে ৫২টা মমির সিটি স্ক্যান করা হয়। তার ৪৪টিতে রক্তনালী এবং ৩৬টিতে হৃৎপিণ্ড শনাক্ত করা যায়। এই মমিগুলোর অধিকাংশেই অ্যাথেরোস্কেলেরোসিস পাওয়া যায় যা আর্মষ্টারডার্মে অনুষ্ঠিত কার্ডিওভাস্কুলার ইমেজিং এর আন্তর্জাতিক কনফারেন্স–এ উপস্থাপিত হয়। এতে হৃদরোগে আক্রান্ত রাজকন্যার সিটিস্ক্যানের ছবি প্রদর্শিত হয়। এতে দেখা যায় ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণকারী সেই রাজকন্যার হৃদপিণ্ডের সব রক্তনালীতে প্রতিবন্ধকতা ছিল।
এতে প্রমাণ হয় যে, এই রোগ ৩৫০০ বছর আগেও মানুষকে আক্রান্ত করতো। যদিও তা আধুনিক সভ্যতার অসুখ হিসেবে পরিচিতি। ঐ রাজকন্যার পিতা মিশরের ১৭তম রাজবংশের শেষ ফেরাউন। রাজকন্যার হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর ব্লকেড এর জন্য তৎকালীন খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করা হয়। তাদের প্রধান খাদ্য ছিল চর্বিযুক্ত রুটি, কেক, গৃহপালিত ও শিকার করা পশুর মাংস ও বিয়ার। তবে ধূমপানের অভ্যাস তখনও শুরু হয়নি। সে সময়ে খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হতো প্রচুর লবণ। তাই খাদ্যের সবটাই প্রচুর সম্পৃক্ত চর্বি ও লবণযুক্ত। প্রাচীন মিশরের মন্দিরে অংকিত ছবি (হায়ারোগ্লিফিক) থেকে তাদের এই খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। রাজা রানী ও পরিবার বর্গের পাশাপাশি তাদের মন্দিরের পুরোহিতগণও এই খাবারে অভ্যস্ত ছিল। কারণ দেবতাদের উদ্যেশ্যে নিবেদিত এই সব খাবার তারাই গ্রহন করতো। এভাবে কয়েক হাজার বছর পরে তাদের মমির সিটিস্ক্যান ও নিউক্লিয়ারিং ইমেজিং পরীক্ষায় করোনারী রক্তনালীতে প্রতিবন্ধকতা সনাক্ত হওয়া হৃদরোগের কারণ হিসেবে খাদ্যাভ্যাসকে প্রতিষ্ঠিত করে। (চলমান)
তথ্যসূত্র : ১। ইন্টারনেট– প্রাগৈতিহাসিক মিশর, প্রাচীন মিশর, সাম্রাজ্যের উত্থান পতন, ২। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কারোনারী হৃদরোগী প্রাচীন মিশরীয় রাজকন্যা– ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি, ১ মে, ২০১১ (প্রেস বিজ্ঞপ্তি), ৩। হরাস সমীক্ষা : প্রাচীন মিশরীয় মমিতে এ্যাথেরোস্কেলরোসিস, জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি ২০১১, ৪। প্রাচীন মিশরীয়দের খাদ্যভ্যাস ও এ্যাথেরোস্কেলরোসিস– ল্যানসেট ৩৭৫ (৯৭১৬), সূত্র, পৃঃ৭১৮–৭১৯, ২০১০; ৫। এবার্স প্যাপিরাস (প্রাচীন মিশরীয় মেডিসিন) ইউকিপিডিয়া।
লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।