হৃদয় আমার ছাত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হৃদয়ের পুরো নাম হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। আমি ওকে তরুয়া বলে ডাকি। কারণ তরুয়া নামটা শুনতে একেবারেই ভিন্নরকম। এই নামে আমাদের বিভাগে একজনই ছিল। সম্ভবত সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও এই নামে অন্য কেউ ছিলনা। বাইশ বছরের এক তরতাজা যুবকের গল্প বলছি। অথচ বলছি– ‘ছিল’। কারণ ও আর নেই। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায়ের সেই চূড়ান্ত মুহুর্তে চট্টগ্রামের বহাদ্দার হাটে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রথমে চট্টগ্রামে এবং পরে ঢাকার দুটি হাসপাতাল ঘুরে যমের সঙ্গে লড়াই করে পাঁচদিন পর ২৩ জুলাই প্রভাতের আলো ফোটার আগে আগে হৃদয়ের হৃদযন্ত্রটি পুরোপুরি থেমে যায়।
এক বুদ্ধিদীপ্ত টগবগে তরুণ তরুয়া। প্রথম দিনেই চোখে পড়ে আলাদা করে, যদিও কৃষ্ণকালো গাত্রবর্ণ, মাথাভরা কালো চুল, মাঝারী উচ্চতার ছেলেটিকে প্রচলিত অর্থে সুদর্শন বলা যায় না। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা ছড়ায়। তরুয়া নামের অর্থ জানতে চাই উপস্থিতির খাতায় নাম ডাকার সময়। পূর্বপুরুষ কাঠমিস্ত্রি, তরুয়া তাদের বংশীয় পদবী। কি অকপট স্বীকারোক্তি ! দারিদ্র কিংবা গ্রাম্যতা লুকোবার কোনো চেষ্টা নেই ওর মধ্যে। ওকে যে ভালোবেসে ফেলি তা নয়, শ্রদ্ধাও করতে শুরু করি। প্রথম দিন হতেই নিয়মিত ছাত্র, মনযোগী শিক্ষার্থী। উপস্থিতির নম্বরের জন্যই শুধুমাত্র সশরীরে শ্রেণিকক্ষে আসে না সে। অদম্য তার জানার আগ্রহ। প্রশ্ন করতে ভালোবাসে; প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক প্রশ্ন। অনুসন্ধিৎসু এই যুবকের প্রতিটি প্রশ্নই আমাকে ভাবায়। ফরাসী বিপ্লবের বহুমাত্রিকতা, বারে বারে মুখ থুবড়ে পড়া, বিপ্লবের বরপুত্র নেপোলিয়নের হাতে বিপ্লবের কবর রচনা ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সবকিছু নিয়েই তার প্রশ্ন, নিদেনপক্ষে বিচক্ষণ অভিমত। ফরাসি বিপ্লব তো শত শত বছরের সামন্ততান্ত্রিকতা, রাজতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থসামাজিক বৈষম্য, বিচারহীনতাসহ অনেক অব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিল, তবু কেন চার দশকের মাথায় জুলাই বিপ্লব হলো? এরপর দুই দশক যেতে না যেতেই আবার কেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এলো? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। তবে উচ্চারণ করে কয়েকজনই, যাদের মধ্যে তরুয়া একজন।
সবসময় প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সারিতে বসে। একদিনই সম্ভবত ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল তরুয়া। আমার চোখ সেদিন শেষের সারি পর্যন্ত ওকে খুঁজেছে। সহপাঠীরা জানায় ওর একটা সমস্যার কথা। পরদিন ওকে আবার যথাস্থানে দেখে আশ্বস্ত হই।
এরপর শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেলে আমি তরুয়াকে কোথায় খুঁজবো? আমাদের যে এখনও অনেক পড়া বাকি। সামনে পরীক্ষা। ছুটির পরে প্যারি কমিউন পড়বার কথা ছিল। সে গল্পটা তো ওর শোনা হলো না। বিপ্লবে বিপ্লবে ক্ষতবিক্ষত ফ্রান্সের ক্ষমতা কয়েক মাসের জন্য হলেও শ্রমিক জনতার হাতে এসেছিল। দেশে দেশে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, উদারতা ও মানবতার যত গালভরা বুলিই আওড়ানো হোক না কেন, ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে কেউ সর্বহারাদের দেখতে যায় না, ঠিক যেমন করে হিরো আলমকে গণমাধ্যমে দেখলে আমি তিরস্কার করি, রুচিহীনতার প্রশ্ন তুলি। এটাই জগতের রীতি। এটাই সভ্যতার প্রহসন। আমি কি পারবো কোনোদিন ড. আবদুল করিম ভবনের ৩১৯ নম্বর কক্ষে তরুয়ার সহপাঠীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে! ইতিহাসের এই অসম্পূর্ণ অধ্যায়গুলো ওরা কি পড়বে? নাকি নিজেরাই রচনা করবে নতুন ইতিহাস?
জুনের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আযহার ছুটির আগে ওদের সাথে শেষ দেখা। এরপর আর শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে পারিনি। কি এক অসহনীয় যুদ্ধ চলছে দেশজুড়ে ! কেউ এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। চলমান অস্থিরতা সবাইকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে।
১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার। বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয় তরুয়া। গুলিটা খুব কাছ থেকে করা হয়; পিঠের একপাশ দিয়ে ঢুকে গলা দিয়ে বের হয়ে যায়। গমনপথে ওর ভেতরে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় ঘাতকের বুলেট। ও মিছিলে গিয়েছিল কিনা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মতো ওর জীবিকারও একমাত্র অবলম্বন ছাত্র পড়ানো। কাজ শেষে হয়তো গন্তব্যে ফিরছিল, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের দরজা সেদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কে জানে সে কোথায় ফিরছিল! বন্ধুরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে অবস্থান করে চব্বিশ ঘণ্টার কিছু বেশী সময়।
সহকর্মী দেবাশীষ আর তরুয়ার সহপাঠী তকির কাছ থেকে খবর নিচ্ছি একটু পরপর। এই শুনি রক্ত লাগছে, এই শুনি অপারেশন হবে। বিভাগের শিক্ষকদের হোয়াটস গ্রুপে বার্তা আসার কিছুক্ষণ পরই বন্ধ হয়ে যায় অন্তর্জালের সংযোগ। সীমাহীন অন্ধকার আর শূন্যতায় নিমজ্জিত হয় সমগ্র দেশ; না ওদের খবর নেওয়া যাচ্ছে, না কোনো অর্থ আদান প্রদান করা যাচ্ছে। আঙুলের ছোঁয়ায় বিশ্ব দেখা জাতিকে এমন দুর্ভোগও পোহাতে হয়! হাসপাতালে অবস্থানরত শিক্ষক ও সহপাঠীরা জনে জনে হাত পেতে টাকা তুলছে তরুয়ার জন্য। দুর্বিসহ একটা রাত কত দীর্ঘ হতে পারে সেদিনই উপলব্ধি করি।
শুক্রবার সকাল। গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষ ছাত্রকে দেখতে হাসপাতালে যাই প্রাণটাকে হাতে নিয়ে। সঙ্গে বিভাগের সভাপতি আর আমার মেয়ের বাবা। চারপাশ খাঁ খাঁ করছে। আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। ধূসর পাতারা স্থির হয়ে আছে। মোড়ে মোড়ে সতর্ক প্রহরায় সশস্ত্র পুলিশ। যান চলাচল তেমন নেই। শহরের বুকে আগের রাতের দগদগে ঘা।
হাসপাতালের সর্বত্র লোকে লোকারণ্য। বেসরকারি একটি হাসপাতালের এই চিত্র হলে সরকারি হাসপাতালের চিত্র কেমন হতে পারে, ভাবতেই শিউরে উঠছি। দর্শনার্থী প্রবেশের অনুমতি মেলার পর বিশেষ পোশাক গায়ে মাথায় চাপিয়ে ধীর পায়ে প্রবেশ করি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। দুই সারি বিছানার কোনোটাই খালি নেই। নিস্তেজ হয়ে পড়েছে আমাদের ছেলেরা। নানা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ওরা। কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউবা গুরুতর আহত। প্রথম সারির দুই নম্বর বিছানায় তরুয়া। ওকে চেনা যায় না। কত যন্ত্রপাতি লাগানো ওর শরীরে! মাথাটা টান টান করে রাখা হয়েছে। ঘাড় ঘোরানোর উপায় নেই। কিন্তু ওর চেতনা আছে। কাছে গিয়ে আস্তে করে তরুয়া বলে ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকায়। অভয় দেই ওকে– দেখবে খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে, চিন্তা করোনা। কিন্তু ভেঙে পড়ি নিজে। কীভাবে সেরে উঠবে ও ! ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। উপস্থিত সেবিকার কড়া মানা।
কয়েক মিনিট পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসি। মনে হল একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। এতোকাল শুনেছি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে মৃত্যুপথযাত্রী বয়োবৃদ্ধদেরকে রাখা হয়। আজ দেখছি সব তরুণ শুয়ে কাতরাচ্ছে সেখানে।
চিকিৎসকের পরামর্শে তরুয়াকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। চট্টগ্রামের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক ছাড় দেয়। অনেক অচেনা মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধ ও মানবিকতার যুগপৎ সহঅবস্থান ইতিহাস অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছে। রবিবার সকালেও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কেঁপে উঠছে শরীর। অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসছে। অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষার পালা দীর্ঘতর হতে থাকে। হায় তরুয়া! আদিনিবাস ফেলে কেনই বা এলে এই প্রাণহীন শহরে! ঈশ্বরের দেখা পেতে ভদ্রপল্লীতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করাটা উচিত হয়নি তোমার। ভদ্রপল্লীর কদর্যরূপ তো দেখলে এবার। এ অচলায়তন বুঝি ভাঙার নয়।
প্রথমে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে, দিন দুই পর নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুরো পাঁচটি দিন হৃদয় লড়াই করে মৃত্যুর সঙ্গে। জ্ঞানও থাকে। এতো রক্তক্ষরণ, অক্সিজেনের মাত্রা ওঠানামা নীরবে সয়ে যায় ছেলেটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শুয়ে শুয়ে। পঞ্চম দিনে চিকিৎসকগণ আশার আলো হারাতে থাকেন। মাকে নিয়ে আসার জন্য তাগাদা দেন। দেশজুড়ে কারফিউ চলছে। পটুয়াখালী সদরের মুন্সেফ পাড়া হতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মাকে আনা হলেও মায়ে ছেলের শেষ দেখাটা আর হয় না। অর্চনা রানী যখন ছেলের মুখ দেখেন, ছেলে তখন এ জগতে নেই; তার মুক্ত আত্মা যাত্রা করেছে অনন্তলোকে। অর্চনা রানী কেমন করে সইলেন? তিনি কি আর্তনাদ করেছিলেন? তাঁর দুঃখে আকাশ বাতাস বৃক্ষরাজি তরুলতা কি কাঁদছিল? ওরা আর কত কাঁদবে? অর্চনা রানীতো একজনই নন। সাইদের মা মনোয়ারা থেকে শুরু। পুত্রহারা মায়ের সংখ্যা দুশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন আসছে নতুন মৃত্যুর খবর। শিশু কিশোর বৃদ্ধ যুক্ত হয় তালিকায়।
আমি আজ কাঁদতে এসেছি, বিচার চাইতে নয়। বিচার পাওয়াতো আমার অধিকার। তরুয়ার মা পটুয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন– ‘সবতো শেষ হয়ে গেল। এতো করে বললাম ছেলেকে– দূরদেশে পড়তে যাসনে। কথা শোনেনি ছেলেটা’। কারও বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ নেই। ছেলেকেই যেন দুষলেন অর্চনা রাণী।
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়