হুলাইনের ৪০০ বছরের পুরনো ‘মুছা খাঁ জামে মসজিদ’

শফিউল আজম | সোমবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

সবুজে ঘেরা ও পাখির কলকাকলিতে ভরা পটিয়ায় হুলাইনের ৪০০ বছরের পুরনো ‘মুসা খাঁ মসজিদ’। ১০৬৬ হিজরীতে ভারত বর্ষ থেকে আগত শেরমস্ত খানের পুত্র আজিজ খাঁ রোয়াজা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক নির্মিত চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ নির্মাণের ১০ বছর পূর্বে এই মসজিদটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু কালের আবর্তে কয়েক দফায় সংস্কারে মসজিদটির ইট সুরকিতে তৈরী ৪০০ বছরের পুরনো সেই কারুকাজ ও নানা নির্মাণ শৈলী হারিয়ে গেছে। শুধুমাত্র বর্তমানে মসজিদের দেয়ালে একটি শিলালিপিই অবশিষ্ট রয়েছে।

তখন মসজিদটিতে একটি কারুকাজ সম্বলিত ১টি মিম্বর ও চার কোণায় ৪টি আরবি ও কারুকাজে সজ্জিত মিনার ছিল। মসজিদের প্রবেশে গোলাকৃতির একটি দরজা ছিল এবং দেওয়ালগুলো ছিল সাড়ে ৩ ফিট থেকে ৪ ফিট চওড়া। তখন মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হতো না বলেও জানা যায়। বিশেষ করে জোহর আছর ও মাগরিবের নামাজ হলেও, ব্যাপক ঝোঁপঝাড় ও অন্ধকার এলাকায় ভয়ের কারণে ফজর ও এশা নামাজ আদায় হতো না। এমন দাবী স্থানীয় ষাটোর্ধ বিভিন্ন ব্যক্তিদের।

মসজিদে মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা না হওয়ায় মসজিদটি পুন:নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে ৪০০ বছরের পুরনো অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে জানিয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি এডভোকেট মজিবুর রহমান খাঁন জানান, মসজিদটি নির্মাণকালে ৩০জন মুসল্লির ধারণ ক্ষমতা ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আজিজ খাঁ রওজা পুরো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। তার নয় ছেলে ও ২ মেয়ে ছিল। নয় ছেলেরা হলো গজন্দর মওয়ালী, মুছা খাঁ, দরিয়া খাঁ, তেজবাজ মওয়ালী, শেখ আদম মওয়ালী, শেখ আকবর মওয়ালী, মোহাম্মদ আলী, হুদন ফকির ও ইউনুস ফৌজদার। তবে মেয়েদের ব্যাপারে তাদের নাম বা কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তার পুত্র মুছা খাঁ মসজিদের সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করেন। যার কারণে মুছা খাঁ জামে মসজিদ নামে মসজিদটি পরিচিতি লাভ করেন।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঢাকা, মসজিদের চতুরপার্শ্বে রয়েছে সবুজের সমারোহ ও কবরস্থান। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কিংবদন্তী গান-‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে। গোরআজাব থেকে এ গুনাহাগার পাইবে রেহাই। কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত ঐ মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত। সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই। কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে আল্লাহর নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে, আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে (আল্লাহর নাম জপতে চাই)। কবির এই গানের মতই যেন মসজিদ ও কবরস্থান একাকার হয়ে আছে। পুরো মসজিদ ঘিরেই বিশাল কবরস্থান। একপাশে তার মাঝ দিয়েই ১০/১৫ ফিটের প্রশস্ত রাস্তা দিয়েই প্রবেশ করতে হয় মুসা খাঁ মসজিদে।

মসজিদের দেয়ালে স্থিতি শিলালিপিটি বাংলায় অনুবাদ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ রশিদ। চার লাইনের ফারসি ভাষায় লেখা এ শিলালিপির প্রথম লাইনে লেখা-‘আল্লাহ এই সম্মুনীত মসজিদ খানি নির্মাণ করেছেন শুভ দৃষ্টিতে’। দ্বিতীয় লাইনে লেখা রয়েছে– ‘শেরমস্ত খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধাআজিজ খান’। তৃতীয় লাইনে লেখা রয়েছে-‘সাবান মাসের ১০ তারিখ’ এবং চতুর্থ লাইনে লেখা রয়েছে-‘১০৬৬ হিজরীতে’।

৪০০ বছর পূর্বে মসজিদটি নির্মাণ করেন আজিজ খাঁন রওজা। তখন তিনি মগ রাজা সুধার্ম রাজার অধীনে চাকরি করতেন। তখন রাজা সুধার্মের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন প্রখর খাঁন। তার মাধ্যমে রাজা সুধার্ম খবর পান তার বিরুদ্ধে আজিজ খাঁ রওজা দূর্গ গড়ে তুলছেন ও পরিখা খনন করছেন। তখন রাজা আজিজ খাঁ রওজাকে আটক করেন। জনশ্রুতি রয়েছে আটকের পর তিনি দু:খ ভারাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং রাজার গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত প্রখর খাঁন কে রাজা শাস্তিমূলকভাবে হত্যা করেন। পরে অবশ্য রাজা আসল ঘটনা জানতে পারেন বলে জানা যায়। আজিজ খাঁন রওজা ও প্রখর খাঁনের খবর কোথায় তা জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে আজিজ খাঁও রওজার কবর পটিয়ার শাহ্‌চান্দ আউলিয়া মাজার এলাকায় কোথাও হতে পারে।

আরো জনশ্রুতি রয়েছে, মসজিদটি সর্বপ্রথম রোয়াজা পুকুর নামে খ্যাত পুকুরের পশ্চিম পাড়ের দক্ষিণ কোণে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে হুলাইন গ্রামের পূর্ব প্রান্তে বর্তমান স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের পাশে কবরস্থান ও চারিদিকে পরিখা খনন করা হয়।

চট্টগ্রাম অঞ্চল তখন মগ শাসিত রাজ্য ছিল। পটিয়ার চক্রশালা ছিল তাদের শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। অঢেল ভূ সম্পত্তির মালিক ধর্মভীরু আজিজ খাঁ রোয়াজা এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করার পর মগরাজার গোয়েন্দা বিভাগ রাজাকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কেল্লা তৈরি করা হচ্ছে বলে প্ররোচিত করে তাকে বন্দী করান এবং বন্দী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তখনকার যুগে মগ শাসিত রাজ্যে অধিক ভূসম্পদের মালিকদেরকে মগরাজা কর্তৃক রোয়াজা উপাধি প্রদান করা হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামে মগদের মধ্যে এখনো সেই উপাধি বিদ্যমান আছে।

আজিজ খাঁ রোয়াজার ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ সাহেব খাঁ এবং তার পিতা শেরমস্ত খাঁ রাজদরবারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, মগরাজা আজিজ খাঁ রোয়াজাকে যে কুচক্রী ব্যক্তির মিথ্যা প্ররোচনায় বন্দী করেন তার কারণ ও ভুল বুঝতে পেরেই কুচক্রী ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। শিলালিপিতে আজিজ খাঁ রোয়াজা মসজিদ নাম থাকলেও তারই সুযোগ্য পুত্র মুসা খাঁ মসজিদটি তার পিতার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ এবং সমস্ত কাজ করায় মসজিদটি মুসা খাঁ মসজিদ নামে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে।

১৯৫৫ সালে তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর ১৯৬২ সালে মসজিদের গম্বুজে ফাটল দেখা দেয়। তখন এলাকার শিল্পপতি সালেহ আহমদ চৌধুরী নিজ অর্থায়নে গম্বুজ মেরামত করে মসজিদের বাইরের কাঠামোগত পরিবর্তনসহ চুনকাম করে মসজিদের সংস্কার করেন। এ মসজিদের ইমাম মরহুম মৌলানা ফজলুল করিম দীর্ঘ ৩৫ বছর বিনা বেতনে মসজিদের ইমামতি করেছেন। তার নিজের মালিকানাধীন ১০২ শতক জমি মুসা খাঁ মসজিদের নামে ১৯৮১ সালে ওয়াকফ করেন।

পরবর্তীতে মসজিদের মুসল্লিদের নামাজের স্থান সংকুলান না হওয়ায় এলাকার শিল্পপতি নুর মোহাম্মদ চৌধুরী মসজিদটি ভেঙে পুনরায় মসজিদ নির্মাণের আর্থিক সহায়তা প্রদানের কথা বলেন। পরে মরহুম আহমদ হোসেন চৌধুরী ও এলাকার বিত্তশালী ব্যক্তিদের সহয়োগিতায় বড় আকারে প্রথম ও দ্বিতল মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ মসজিদের জন্য জায়গা জমিসহ আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। বর্তমানে এডভোকেট মজিবুর রহমান খাঁন সভাপতি ও আলী আজম খাঁন সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এ মসজিদ পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

মসজিদের সাবেক সেক্রেটারী ও সাবেক ইউপি সদস্য মো: জসিম উদ্দীনের তথ্যমতে, তখন মসজিদের মূল অবকাঠামো ছিল আনুমানিক ৪০ ফুট। এতে ২টি জানালা ও ১টি দরজা ছিল। একটি কারুকাজময় গম্বুজ ও মসজিদের চার কোণায় ৪টি মিনার ছিল। বর্তমানে দ্বিতল বিশিষ্ট প্রায় ১০০০ হাজার মুসল্লি ধারণ ক্ষমতার জন্য মসজিদ সম্প্রসারণ করার কাজ চলছে।

লেখক : দৈনিক আজাদীর পটিয়া প্রতিনিধি, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে মোগল বিজয়ের স্মারক : আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ
পরবর্তী নিবন্ধশাক্তপীঠ চন্দ্রনাথ