চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হিসাব শাখার কক্ষটি তিন মাস ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে। কক্ষটি হাসপাতালের হিসাবরক্ষকের। হিসাবরক্ষকের চলতি দায়িত্বে থাকা মো. ফোরকানকে গত ১৭ জুলাই এক আদেশে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. সামিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশে ৫ দিনের মধ্যে কর্মস্থল থেকে ছাড়পত্র নিতে বলা হয়। অন্যথায় আদেশের ৬ষ্ঠ দিন থেকে সরাসরি অব্যাহতি পাইয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে মর্মে আদেশে উল্লেখ করা হয়। ভুয়া ব্যয় মঞ্জুরিপত্র তৈরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিল ছাড়করণের চেষ্টার ঘটনায় মো. ফোরকানকে শাস্তিমূলক এ বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগে আর্থিক সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে আর্থিক সংক্রান্ত দায়িত্বভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দিতে বলা হলেও স্ব-পদে বহাল ছিলেন ফোরকান।
এদিকে, বদলি আদেশের প্রেক্ষিতে ২১ জুলাই মো. ফোরকানকে ছাড়পত্র দেয় জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একই সময় তার দায়িত্বভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু ফোরকান দায়িত্বভার, নথিপত্র কিছুই বুঝিয়ে দেননি। বদলিকৃত কর্মস্থলেও যোগ দেননি। বরঞ্চ ছাড়পত্র দেয়ার পর থেকে হিসাব শাখার কক্ষের চাবিও হস্তান্তর করেননি। সে-ই থেকে কক্ষটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরাও কক্ষটিতে আরেকটি তালা যুক্ত করে। ফলে গত তিনমাস ধরে হিসাব শাখার কক্ষটি তালাবদ্ধ।
ফোরকান দায়িত্বভার-নথিপত্র বুঝিয়ে না দেয়ায় প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনায় নানা জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে হাসপাতাল প্রশাসন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিতে তাকে একাধিক চিঠি দেয়া হয়। পরে তার (ফোরকানের) স্থায়ী ঠিকানায়ও একাধিক তাগিদ পত্র পাঠানো হয়। কিন্তু ডাকযোগে পাঠানো তাগিদ পত্র ফেরত আসে।
সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট এ বিষয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর চিঠি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়- তার (ফোরকানের) এহেন আচরণের ফলে হাসপাতালের কার্যাবলি সম্পাদনে দারুণভাবে ব্যাহত, প্রশাসনিক ও আর্থিক জটিলতার এবং বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায়, তার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও হাসপাতালের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের স্বার্থে তার এহেন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা এবং আইন ও বিধি মোতাবেক পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগও এ বিষয়ে তড়িৎ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বদলি আদেশের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন মো. ফোরকান। মামলা করায় বিষয়টি আইনগতভাবে জটিলতা আরো বাড়িয়েছে। বদলি আদেশ অমান্য, দায়িত্বভার বুঝিয়ে না দেয়া, নথিপত্র ও কক্ষের চাবি হস্তান্তর না করা শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ড বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে তড়িৎ কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। মোটকথা, এক ফোরকানেই চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগে যেন ত্রাহি অবস্থা!
এ বিষয়ে জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজাদীকে বলেন, তাকে (ফোরকানকে) রিলিজ দেয়ার পর থেকেই কক্ষটি তালাবদ্ধ। তাকে অনেকবার চিঠি দেয়ার পরও দায়িত্বভার, নথিপত্র এবং কক্ষের চাবি বুঝিয়ে না দেয়ায় পরবর্তীতে আমরা নিজেরাও আরেকটি তালা যুক্ত করেছি। কক্ষ তালাবদ্ধ থাকায় পুরনো নথিপত্র প্রয়োজন হলে সমস্যা পড়তে হচ্ছে জানিয়ে সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, তার মামলার প্রেক্ষিতে আদালত আমাদের জবাব দিতে বলেছেন। কিন্তু নথিপত্র সব তালাবদ্ধ থাকায় এক্ষেত্রে আমরা সমস্যায় পড়েছি। যার কারণে আদালতের কাছে আমাদের সময় চাইতে হচ্ছে। সর্বশেষ প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কক্ষের তালা খোলার/ভাঙ্গার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে বলেও জানান ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
ফোরকানের বক্তব্য : যা কিছু বুঝিয়ে দেয়া দরকার, তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন মো. ফোরকান। তার দাবি- তাকে অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়েছে। এজন্য প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা করেছেন। মামলা এখন চলমান। কক্ষের চাবি হস্তান্তরের বিষয়ে সরাসরি জবাব না দিয়ে এখানে আইনগত বিষয় রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে সংশোধিত বাজেটে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ হতে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের মের্সাস আহমেদ এন্টারপ্রাইজ কর্তৃক সরবরাহকৃত ৮টি আইসিইউ বেড, ৮টি ভেন্টিলেটর ও ১টি কার্ডিয়াক পেশেন্ট মনিটরের বকেয়া বিল বাবদ ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার ব্যয় মঞ্জুরি আদেশ জালিয়াতির মাধ্যমে ছাড়করণের চেষ্টা হয়। গত ২৮ জুন জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. ফোরকান এ বিল ছাড়করণের চেষ্টা চালান। বিষয়টি ধরা পড়ায় বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় থেকে মো. ফোরকানকে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। পরে তাকে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত কমিটি : জালিয়াতির এ ঘটনা তদন্তে পরদিন (২৯ জুন) তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর। তৎকালীন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে কমিটি গঠনের এ তথ্য জানানো হয়। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরের উপ-পরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) ডা. মো. সাখাওয়াত উল্ল্যাহকে সভাপতি করে গঠিত কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয় চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীকে। আর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সুমন বড়ুয়া কমিটির সদস্য সচিব। তিন সদস্যের ওই কমিটিকে তদন্ত পূর্বক তিন কর্মদবিসের মধ্যে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে আরো ৫ কর্মদিবস সময় চেয়ে আবেদন করে তদন্ত কমিটি। অবশ্য অতিরিক্ত ৫ কর্মদিবস শেষ হওয়ার আগেই গত ৬ জুলাই তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ : ব্যয় মঞ্জুরী পত্রটি জালিয়াতির মূল হোতা চিহ্নিতকরণে আইটি স্পেশালিস্ট ও হস্তলিখন বিশারদকে সদস্য করে আরো অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন বলে মতামত দেয় তদন্ত কমিটি। তবে ভবিষ্যতে যাবতীয় আর্থিক বিষয়ে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বিকে সতর্ক করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও ভবিষ্যত তদন্তের স্বার্থে হিসাবরক্ষক (চলতি দায়িত্ব) মো. ফোরকানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাগ্রহণসহ অন্যত্র বদলি করার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। এর ভিত্তিতে ১৭ জুলাই এক আদেশে মো. ফোরকানকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দুদকে অভিযোগ : ব্যয় মঞ্জুরী পত্র জালিয়াতির মাধ্যমে বকেয়া বিল ছাড়করণের চেষ্টার ঘটনার পরদিন (২৯ জুন) হিসাবরক্ষক মো. ফোরকানকে সকল ধরণের আর্থিক সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর ৩০ জুন এ ঘটনায় চারজনের নাম উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই চারজন হলেন- চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. ফোরকান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মের্সাস আহমেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মুন্সি ফারুক, একই প্রতিষ্ঠানের সাজ্জাদ হোসেন ও মুকিত মন্ডল। বিলের অর্থ ছাড়করণে ভুয়া ব্যয় মঞ্জুরিপত্র তৈরির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয় অভিযোগে।
উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে মের্সাস আহমেদ এন্টারপ্রাইজ কর্তৃক সরবরাহকৃত ৮টি আইসিইউ বেড, ৮টি ভেন্টিলেটর ও ১টি কার্ডিয়াক পেশেন্ট মনিটর কেনাকাটা নিয়ে দুদকে আগে থেকেই মামলা চলমান রয়েছে। মামলা থাকায় এর বিলও আটকে রয়েছে। এরই মাঝে ভুয়া ব্যয় মঞ্জুরি আদেশ তৈরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে গত ২৮ জুন বকেয়া বিলটির অর্থ ছাড়করণের চেষ্টা করা হয়।