হিমায়িত মৎস্য খাতে ধস, এক বছরে রপ্তানি কমেছে ৩শ’ কোটি টাকা

মান পরীক্ষা ফি-তে ভ্যাট, আপত্তি ব্যবসায়ীদের

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২০ at ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ

ভয়াবহ রকমের সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের হিমায়িত মৎস্য খাত। করোনাকালে রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়ায় এক বছরের ব্যবধানে পণ্য রপ্তানিতে ৩০ শতাংশেরও বেশি ধস নেমেছে। ভয়াল এই সংকটের মাঝে ভ্যাট আদায়কে কেন্দ্র করে নতুন এক সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের মান পরীক্ষার ফি’র উপর ভ্যাট আদায়কে কেন্দ্র করে পুরো কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরির আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হিমায়িত মৎস্য দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত। তৈরি পোশাকখাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি হলেও এর বড় একটি অংশ কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়ে যায়। কিন্তু মৎস্য খাতের শতভাগই দেশীয় পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। ফলে এই রপ্তানি খাতের হাজার হাজার কোটি টাকার পুরোটাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা খাতকে সমৃদ্ধ করে। এর কোনো অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে পুনঃরপ্তানি করতে হয় না। প্রতি বছর এই খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ এবং মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ায় হিমায়িত মৎস্য খাতের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চট্টগ্রামের এই সেক্টরে জড়িত বহু প্রতিষ্ঠানই দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা পরিণত হয়েছে খেলাপি ঋণে। চট্টগ্রামে ৩৫টির মতো প্রতিষ্ঠান হিমায়িত মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও এদের অন্তত অর্ধেকই দিশেহারা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মাত্র ৩২২ কোটি টাকার হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি হয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অথচ ২০১৯ সালে এই সময়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সর্বমোট ৮১৫ কোটি টাকার হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি করেছিল। এক বছরের ব্যবধানে করোনার কারণে মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ অন্তত ৩০০ কোটি টাকা কমে যাবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলতি বছর মাত্র ১৮টি প্রতিষ্ঠান হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি করতে পেরেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের কোনো খবরই নেই। দেশের হিমায়িত মৎস্য রপ্তানিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে সূত্র বলছে, এজন্য সরকার হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি খাতকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতার চেষ্টা করছে। সাগরে মাছ ধরা কিংবা চাষ থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে দেয়া হয় সহায়তা। এরই অংশ হিসেবে শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরি টেস্ট চার্জের উপর ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে ২০১৯ সালের ১৩ জুন এসআরও নম্বর ১৮৮-আইন/২০১৯/৪৫-মূসক জারি করা হয়। কিন্তু সরকারি এই আইন না মেনে মৎস্য অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি টেস্ট ফি’র উপর ভ্যাট আদায় অব্যাহত রেখেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশের হিমায়িত মৎস্য খাত থেকে কুকড (রান্না করা) এবং ‘র’ (কাঁচা) অবস্থায় চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ রপ্তানি হয়ে থাকে। রপ্তানির জন্য পণ্য তৈরি করে কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবকে খবর খবর দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রপ্তানির জন্য তৈরি করা পণ্য থেকে রেনডম প্রক্রিয়ায় নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে আসেন এবং পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রদান করেন। পরীক্ষায় যথাযথ মান নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চালানটি রপ্তানির অনুমোদন পায়। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি আদায় করা হয়। চট্টগ্রাম থেকে চলতি বছর অন্তত ৪১৫টি চালান রপ্তানি হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের ৪১৫টি পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়েছে।
রপ্তানিকারকেরা নমুনা পরীক্ষার ফি প্রদান করতে কোনো ধরনের আপত্তি করেন না। সংকট তৈরি করেছে সেই ফি’র উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিয়ে। সরকারিভাবে এই ভ্যাট অব্যাহতির এসআরও থাকার পরও মৎস্য অধিদপ্তর লাখ লাখ টাকার ভ্যাট আদায় করছে।
বিষয়টি ‘মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’র মতো অবস্থা তৈরি করেছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকরা বলছেন, আমাদের এমনিতেই দিশেহারা অবস্থা। এরমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই আমাদেরকে বাড়তি টাকা প্রদান করতে হচ্ছে। যা আমাদের ব্যবসার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রপ্তানিকারক বলেন, আয় রোজগার একেবারে তলানিতে। কোনো রকমে শ্রমিক কর্মচারী এবং পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। এই ভয়াবহ অবস্থার মাঝে প্রতিটি চালান থেকে ভ্যাটের নামে এতগুলো টাকা আদায় করে নেয়া হচ্ছে। বিষয়টি বড় ধরনের অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে। অথচ আমাদের থেকে জোর করে ভ্যাট নেয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদেরকে সবকিছু নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এঙপোটার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এস এম মোরশেদ জাফর দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, সরকারের আইন না মানার এই প্রবণতা সংকট তৈরি করছে। এতে রপ্তানি কার্যক্রম নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে সরকার আইন করে দিয়েছে। অথচ এই আইন লংঘন করে ভ্যাট আদায়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক এই মহামারীকালে রপ্তানিকারকদের ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে এসআরও’র বর্ণিত নিয়মে মান পরীক্ষার অনুরোধ জানান।
এই ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন কোয়ালিট কন্ট্রোল ল্যাবরেটরির কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ম্যানেজার ড. নিয়াজ কাইয়ুমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভ্যাট নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, একটি এসআরও রয়েছে একথা ঠিক। কিন্তু তা স্পষ্ট নয়। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পত্র দেয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আসলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তবে নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত আগের নিয়মেই আমরা ভ্যাট আদায় করব, বললেন ড. নিয়াজ কাইয়ুম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো বাড়ছে
পরবর্তী নিবন্ধকদমতলীতেও অবৈধ জর্দার কারখানা