হিমছড়ি উপকূলে ভাসছে বিশালাকৃতির মরা তিমি

এর শরীরে প্যাঁচনো রয়েছে জাল ও বয়া

কক্সবাজার প্রতিনিধি | বুধবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের হিমছড়ি উপকূলের কাছাকাছি অগভীর জলে একটি বিশাল আকৃতির মরা তিমি ভাসছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিমিটি সামুদ্রিক জোয়ারের সঙ্গে উপকূলের কাছাকাছি আসে। বলিন জাতের এই মরা তিমিটি রাত সোয়া ৮টায় এ রিপোর্ট লেখাকালীন পর্যন্ত উপকূলের একই স্থানে অবস্থান করছিল বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বিজ্ঞানীরা। এর আগে ২০২১ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল একইস্থানে দুটি মৃত তিমি ভেসে এসেছিল, যে তিমিগুলোও একই প্রজাতির ছিল বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে হিমছড়ি উপকূলের কাছাকাছি একটি তিমি ভেসে আসার খবর পেয়ে সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে র‌্যাপিড একশন টিমের বিজ্ঞানিরা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু তিমিটি সৈকত থেকে দূরে অবস্থান করায় সাগরে ড্রোন পাঠিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর এর প্রজাতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তিমিটি এখনও সৈকত তীর থেকে ২০০২৫০ মিটার দূরে সাগরে ভাসছে।

তিমিটি অন্তত এক সপ্তাহ আগেই মারা গেছে বলে মনে করছেন তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিমিটির শরীরে বিভিন্ন অংশে পচন ধরায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর শরীরে জাল ও বয়া প্যাঁচানো রয়েছে। মাথায় আঘাতের চিহ্নও দেখা গেছে। সাধারণত মৎস্য শিকারিদের জালে আটকা পড়ে, জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে কিংবা সমুদ্র দূষণের কারণে পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ও দিকভ্রান্ত হয়ে উপকূলের অগভীর জলে এসে আটকা পড়ে মারা যায় তিমি। তিনি জানান, উপকূলে ভাসতে থাকা এই তিমিটি ‘ব্রাইড’স হোয়েল’ বা বলিন তিমি হিসেবে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম বলিনোপেট্‌্রা ইডেনি। এ প্রজাতির তিমির দাঁত নাই। এরা মুখের মধ্যে চিরুনির মতো একটি অংশ দিয়ে খাবার প্রক্রিয়াজাত করে। বোরির বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, স্থানীয় পুলিশ, মৎস্য অধিদপ্তর, বনবিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম জানান, বিষয়টি বনবিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ বিভাগকে জানানো হয়েছে। তবে তিমিটি সমুদ্রতীরে না আসা পর্যন্ত কিছুই করা যাচ্ছে না। সৈকতে আসার পরই সেটিকে পুঁতে ফেলা সম্ভব হবে।

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে প্রায়শ নানা সামুদ্রিক প্রাণির মৃতদেহ এবং জৈবঅজৈব বর্জ্য ভেসে আসে। আর গত তিনমাসে ভেসে আসে শত শত মরা রাজ কাঁকড়া, জেলিফিশ, কচ্ছপ ও ডলফিনসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণি। সাগরে তিমি ও তিমি জাতীয় প্রাণিদের বিশাল পরিবেশগত সেবার কারণে পরিবেশ বিজ্ঞানে এদেরকে ইকোসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার্স বা বাস্তুসংস্থান প্রকৌশলী বলা হয়। তিমিরা তাদের স্বভাবজাত বা আচরণগত প্রকৌশলের মাধ্যমে শুধু নিজেদের বসবাসের পরিবেশ ঠিক রাখে না, অন্য প্রাণিদের জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়। যে কারণে তিমিরা যে পরিবেশে বসবাস করে সেই পরিবেশকে ধরা হয় একটি উর্বর, জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ নির্মল পরিবেশ হিসেবে। সাগর বা মহাসাগরে কার্বন চক্র ও নাইট্রোজেন চক্রসহ অসংখ্য পুষ্টিচক্র সক্রিয় থাকে, যে পুষ্টিচক্রের উপর নির্ভর করে টিকে থাকে সাগরের প্রাণিরা। এই ধরনের একটি পুষ্টিচক্র হলো হুয়েল পাম্পিং, যেটি তিমিদের একটি আচরণগত কার্যকলাপের কারণে তৈরি হয়।

বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তার ৯০ শতাংশই কমায় সমুদ্রে থাকা ফাইটোপ্লাংক্টন; যা একধরনের ক্ষুদ্র সবুজ উদ্ভিদ। এরা প্রতি বছর ২ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ কমায়। ফাইটোপ্লাংক্টন সামুদ্রিক প্রাণিদের জন্যও একটি পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ ফাইটোপ্লাংক্টন সমুদ্রের উপরি স্তরে তাদের জীবনচক্র শেষ করার পর তাদের দেহাবশেষ সাগরের তলদেশে গিয়ে জমা হয়। আর তিমিরা সাগরের তলদেশে জমাকৃত এই অব্যবহৃত পুষ্টিকে পুনরায় উপরিস্তরে নিয়ে এসে সামুদ্রিক প্রাণিদের জন্য খাদ্য যোগান তৈরি করে। তিমিদের এই কার্যক্রমই হুয়েল পাম্পিং নামে পরিচিত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের বাণিজ্যিক চলাচল প্রশ্নে রুল
পরবর্তী নিবন্ধবিএসসির জন্য কেনা হচ্ছে ৪ জাহাজ