হিজরি বর্ষের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছালেহ | সোমবার , ৮ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে শুধুমাত্র খ্রিস্টাব্দ এবং খ্রিস্ট মাসগুলোর ভিত্তিতে তারিখ গণনা করা হতো, মুসলমানদের মধ্যে তারিখ হিসাব করার রীতি ছিলনা। মহানবী (.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ১৭ বছর পর যখন হযরত ওমর (রা.) খেলাফতের দায়িত্বে ছিলেন। তখন প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) হযরত ওমর (রা.) এর নিকট একটি চিঠি লিখে বলেন, আপনার পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাজে গভর্নরদের নিকট বিভিন্ন সময় চিঠির মাধ্যমে নানা ধরনের হুকুম জারি করা হয় কিন্তু সেখানে চিঠিতে কোনো ধরনের তারিখ উল্লেখ থাকে না। ফলে দায়িত্ব প্রাপ্ত শাসকগণ কোন হুজুম কখন বাস্তবায়ন করবেন তা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভ্রান্তির উদ্বেগ থাকে। কিন্তু তারিখ উল্লেখ থাকলে, আপনি কোন বিষয়ে কোন আদেশ কোন দিন জারি করলেন আর কখন তা পৌঁছবে বা কোন দিন থেকে তার উপর আমল করা হবে সমূদয় বিষয় তারিখ লিখার উপর নির্ভর করবে। এ সংবাদ পেয়ে হযরত ওমর (রা.) চিন্তাকরে দেখেন যে, এটা খুবই জরুরী এবং কল্যাণকর বিষয় তৎক্ষণাৎ ইসলামি খেলাফতের উপদেষ্টা এবং প্রসিদ্ধ বিজ্ঞ সাহাবীদের পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় সাহাবীগণ থেকে চারটি মতামত পেশ করেন।

১। মহানবী (.) এর সুভাগমনের দিন থেকে সাল গণনা শুরু করা যেতে পারে।

২। মহানবী (.) এর নবুয়তে প্রকাশের বছর থেকেই সাল গণনা করা যেতে পারে।

৩। মহানবী (.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় সাল থেকে গণনা শুরু করা যেতে পারে।

৪। মহানবী (.) এর ইন্তিকালের বছরকে কেন্দ্র করে ইসলামী বছর সাল শুরু করে যেতে পারে।

উক্ত ৪টি প্রস্তাবনার উপর বিশদ আলোচনা পর্যালোচনার পর হযরত ওমর (রা.) বললেন নবুয়ত বা খেলাফতকে কেন্দ্র করে সাল গণনা শুরু হলে মানুষের মাঝে বিভিন্ন মতানৈক্য দেখা দিতে পারে। কেননা মহানবী (.) এর আগমন এবং ইন্তিকালের দিনটি একই সময়ে সম্পন্ন হলেও এর সঠিক দিন ও তারিখ কোথাও লিপিবদ্ধ নেই ফলে মতানৈক্য বিদ্যমান। আর ইন্তিকালের দিনটিকে মুসলমান এখনো হুজুর (.) এর বিয়োগ ব্যথা অনুভব করে অন্তর ব্যথিত হয়, তাই মহানবী (.) এর হিজরতকে কেন্দ্র করে ইসলামি বর্ষ গণনা করাই যুক্তি যুক্ত, তবে এতে ৪টি উপকারিতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন

(এক) মহানবী (.) এর হিজরতই মুসলমানদের মাঝে হক ও বাতেলকে চিহ্নিত করে দিয়েছে।

(দুই) হিজরতের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় আর মুসলমানদের আত্ম মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

(তিন) হিজরির মাধ্যমে মহানবী (.) এবং মুসলমানরা কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়াই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়।

(চার) হিজরতের বছরই মসজিদে নববীর প্রতিষ্ঠা হয়। উপর্যুক্ত বর্ণনায় প্রেক্ষিতে সকল সাহাবী হিজরতের বছরকে ইসলামি বর্ষ হিসেবে পালনের জন্য ঐকমত্য পোষণ করেন এবং হিজরি সনের সূচনা করেন।

উক্ত সভায় আরো একটি বিষয় উত্থাপন করা হয়, তা হলো বছরে ১২ মাস তৎমধ্যে ৪ মাস মহররম তথা যুদ্ধ বিগ্রহ নিরাপদের মাস যথাযিলকদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি রজব যা জমাদিউস সানী এবং শাবানের মাঝে অবস্থিত। এ বিষয়ে সাহাবীগণ ৪টি মতামত ব্যক্ত করেন

() রজব থেকে বছর শুরু করা যেতে পারে। কেননা রজব থেকে যিলহজ্ব পর্যন্ত ৬ মাস অতঃপর যিলহজ্ব থেকে রজব পর্যন্ত অবশিষ্ট ছয় মাস হয়।

() রমজান মাস থেকে বছরের নাম গণনা শুরু করা হয় কেননা রমজান মাস তৎপর্যপূর্ণ মাস যাতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়।

() মহররম থেকে মাস গণনা শুরু করা যেতে পারে, কেননা মহররম মাসে মানুষরা হজ্ব সম্পন্ন করে বাড়িতে ফিরে নতুনভাবে তাদের কাজ কর্ম শুরু করে।

() রবিউল আউয়াল থেকে মাস গণনা শুরু করা যায় কেননা মহানবী (.) রবিউল আওয়াল মাসেই পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।

হযরত ওমর (রা.) মনোযোগ সহকারে সকলের মতামত শুনলেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, মহররম মাস থেকে হিজরি বর্ষ শুরু হবে। এক্ষেত্রে ২টি বিশেষ কারণ রয়েছে

() মদিনার আনসার সাহাবীরা আকাবার শপথে মহানবী (.) কে মদিনায় আগমনের দাওয়াত দিয়েছিলেন মহানবী (.) তা কবুল করেছিলেন। এটা হয়েছিলেন যিলহজ্ব মাসে। মহানবী (.) মহররম মাসেই সাহাবীদের হিজরতের নির্দেশ দিয়েছিলেন আর সর্বশেষ রবিউল আওয়াল মাসে মহানবী (.) হিজরতের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে।

() হজ বছরে একবার হয়ে থাকে, হজ আদায় শেষে হাজিরা মহররম মাসে আপন আপন ঘরে ফিরে যায় এবং নতুন উদ্যোমে কর্মজীবন শুরু করেন। উপর্যুক্ত কারণে মহররম মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য করা হয় আর সকল সাহাবী এ বিষয়ের উপর ঐক্যমত পোষণ করেন।

সুতরাং ইসলামী বছর হিজরতের বছর থেকে আরবি মাস গণনা শুরু হয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বান্দার যাবতীয় আমল, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ ইত্যাদি ইসলামী তারিখের ভিত্তিতে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু সূর্য বছর তথা খ্রিষ্টাব্দের সাল বা তারিখের অনুযায়ী কোন ইবাদতের নির্দেশ দেননি।

সর্বোপরি হিজরী নববর্ষ আমাদের দেশ ও জাতির জন্য সুখ, কল্যাণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক আর আমাদের অন্তর ও বর্হিজগতের যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, ক্লেশ ঝড়ে মুচে যাক। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য ১৪৪৬ হিজরি সমৃদ্ধি ও উন্নতির বার্তা নিয়ে আসুনআমিন। বেহুরমতে সাইয়্যেদিল মুরসালিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা।

চেয়ারম্যান, হিজরি নববর্ষ উদ্‌যাপন মঞ্চ

পূর্ববর্তী নিবন্ধকমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিকদের সংকট ও সমাধান
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা : যিনি ইতিহাস গড়লেন