রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মানবজীবনের সম্পর্ক। মানুষের মানসিক জীবনটা কোনখানে? যেখানে আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয়, বাসনা এবং অভিজ্ঞতা সবগুলি গলে গিয়ে মিশে গিয়ে একটা সম্পূর্ণ ঐক্য লাভ করেছে। যেখানে আমাদের বুদ্ধি প্রবৃত্তি এবং রুচি সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এককথায় যেখানে আদত মানুষটি আছে। সেখানেই সাহিত্যের জন্মলাভ হয়।’ রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন, ‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।’ এদিকে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘সাহিত্যের উপাদান হচ্ছে মানবজীবন ও প্রকৃতি। মানবজীবনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়। তবে সাহিত্য মানবজীবনের বস্তুগত রূপ নয়, আবার প্রকৃতির হুবহু অনুকরণও নয়। মানবজীবন ও প্রকৃতি থেকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে উপযুক্ত উপাদান নির্বাচন করে শিল্পী মনের রূপ–রস, সুখ–দুঃখ, আশা–আকাঙ্ক্ষা মিলিয়েই সৃষ্টি হয় প্রকৃত সাহিত্য।’
স্পষ্টত আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে জ্ঞানের বিষয় না বলে ভাবের বিষয় বলেছেন। তবে আমাদের সমাজতাত্ত্বিকরা বলেছেন, ‘জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো কিছুই সুন্দর নয়। জীবনের প্রয়োজনের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্বও নেই।’ তারা আরো বলেছেন, সাহিত্য জীবনের প্রয়োজন থেকে উৎসারিত হয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
এজন্য ‘সাহিত্য’ বলতে আমরা বুঝি সেসব রচনা, যা হৃদয় থেকে উৎসারিত। মার্কিন কবি ম্যাকলিশের কথায়, ‘প্রকৃত সাহিত্যের জন্ম তখনই, যখন ভাষার সৌন্দর্য ও আবেগের ক্রিয়াশীলতা শব্দের আশ্রয়ে রূপ লাভ করে।’
সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘একটা সুন্দর সনেট না পড়লে দুঃখ নেই, কিন্তু পড়লে খুশিতে মন ভরে ওঠে। দৈনিক পত্রিকা না পড়লে দিনটা মাটি হলো বলে মনে হয়, কিন্তু পড়লে তেমন তৃপ্তি পাওয়া যায় না। একটা ভালো সাহিত্যের বই না পড়লেও চলে, কিন্তু পড়লে মন আনন্দে নেচে ওঠে–জীবনকে সার্থক বলে অভিনন্দিত করতে ইচ্ছে হয়।’ বাস্তবিক অর্থে মানুষের জীবনে সুন্দরের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাব্য সমালোচকদের মতে, জীবনের জটিলতার ধারণা স্বভাবতই আধুনিক কবিতাকে দিয়েছে নতুন সুর, নতুন ব্যঞ্জনা। আধুনিক কাব্য নিছক প্রেরণাজাত কোনো বস্তু নয়। এর পেছনে আছে বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের চর্চা, নিঃসঙ্গতার অপার বেদনা। অনেকক্ষেত্রে এটাকে স্বেচ্ছাচার হিসেবে দেখা হচ্ছে। কবি বা লেখক যা ভাবছেন, যা দেখছেন, সেটাই তুলে আনছেন তাঁর লেখায়। তাঁর দেখা ও বলার ভঙ্গি নিয়ে কথা বলা যায়, কিন্তু তাঁর বিশ্বাসকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা যায় না। কেউ সহজ সরল পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ কঠিন বা দুর্বোধ্যতাকে আলিঙ্গন করছেন, সে–বিষয়ে ভাবনার তারতম্য আছে, আছে মতের পার্থক্য। এ নিয়ে অনেকে অনেক রকম কথা বলেন, সমালোচনা করেন। তবে আমরা বিশ্বাস করি, সমালোচনা না থাকলে লেখক অনেকক্ষেত্রে ভুল পথে থেকে যেতে পারেন। সমালোচনা হলো সাহিত্যের গবেষণা, আলোচনা, মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা। যদিও আজকাল সমালোচনার নামে যা হচ্ছে, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা কষ্টের। সাহিত্য–সমালোচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য–সমালোচকের দায়িত্ব কী হওয়া উচিত সেটি তার চেয়ে সুন্দরভাবে কেউ দেখিয়ে যান নি। রাজীব সরকার তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘যথার্থ সাহিত্য–সমালোচনার জন্য বিস্তৃত জ্ঞানের পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিক ও যুক্তিবাদী দার্শনিকতা প্রয়োজন। আমাদের লেখক সমপ্রদায়ের মধ্যে এমন লেখক কম পাওয়া যাবে যিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে অন্য কোনো লেখকের বই গুরুত্বসহকারে পড়েন এবং উপযুক্ত মূল্যায়ন করেন। চেনা–জানা বলয়ের লেখকদের কাছ থেকে বই উপহার পেয়ে এবং তাদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে দায়সারা গোছের কিছু মন্তব্য এখন সমালোচনার নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ সমালোচনা করতে গিয়ে যদি কেউ কোনো লেখকের প্রশংসা করেন, মন খুলে অভিনন্দন জানান, তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যখন তার বিপরীত কিছু বলতে যাবেন, তখন সমালোচককে যুক্তি উপস্থাপন করে দেখাতে হয়। ভালো লাগার কারণ না বললেও মন্দ লাগার কারণ স্পষ্ট করতে হয়। আবার দেখি সমালোচনা আর নিন্দাকে অনেকে এক করে ফেলেন। যদিও নিন্দাকেও গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি একটি কবিতায় বলেছেন : ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো/যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।’
আমাদের লেখকদের মধ্যে বেশিরভাগই সমালোচনা সহ্য করেন না। এই সহ্য না করাকে অনেকে এক প্রকার মানসিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন, সাহিত্যে সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তাকে খোলামনে অনুধাবন করা জরুরি। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করার মতো মানসিক উদারতা থাকতে হবে। প্রত্যেকে সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করলেও লেখকদের মধ্যে তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা কম।
হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে শিলা আহমেদের একটি লেখা পড়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন বাবার লেখালেখি বিষয়ে। সেখানে দেখলাম হুমায়ূন আহমেদও তাঁর লেখার সমালোচনা পছন্দ করতেন না। শিলা লিখছেন :
“আমার বাবা ছিল লেখক মানুষ। তার ছোট্ট কাঠের একটা টুল ছিল। সেটা নিয়ে যেখানে সেখানে লিখতে বসে যেত। আমাদের খেলা–ঝগড়া–হাসাহাসি কোন কিছু্ তার লেখালেখিতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারতো না।
এবার প্রথম আমার বরকে দেখলাম লেখক হিসেবে। একেবারে বাবার উল্টো। ওর লেখার জন্য পিসফুল মাইন্ড লাগে। চুপচাপ বাসা লাগে। আর লেখার সময় কেউ ওর সাথে কথা বলতে পারবে না। বেচারার জন্য বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল!
পিসফুল মাইন্ড সম্ভব না, কারণ ছোটবেলা থেকে আমি খুব ঝগড়াটে। চুপচাপ বাসাও সম্ভব না, কারণ বাসায় চারটা বাচ্চা। আর ওকে একটু পর পর ডাকাডাকি করা আমার স্বভাব।
এতো ঝামেলার মধ্যেও যখন সে একটা উপন্যাসের অর্ধেকের মত লিখে ফেললো, তখন আমাকে পড়তে দিলো। বললো–পড়ে দেখোতো কেমন হয়েছে? কোনো জায়গায় ঠিক করতে হলে, বলো! আমি বললাম– অবশ্যই পড়বো, কিন্তু কোনো জায়গা ঠিক করতে হবে কিনা, বলতে পারবো না।
আমি লেখকের মেয়ে, সারাজীবন দেখেছি লেখকরা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। বাবাকে কোনো লেখা নিয়ে একটু কিছু বললে প্রচণ্ড রেগে যেতো। এমন বকাবকি শুরু করতো যে ভয়ে অনেকক্ষণ সামনে যেতাম না!
ও হাসতে হাসতে বললো– আরে ধুর আমি কি তোমার বাবার মতো ছেলেমানুষ নাকি! আমাকে চিনো না? আমি খুব ভালোভাবে সমালোচনা নিতে পারি। তুমি নির্দয়ভাবে সমালোচনা করবে।
: কেমন হয়েছে?
:ভালো!
:ভালো মানে কী? ঠিকমতো বলো।
আমি ওকে অল্পকিছু বলি। মনে হয় এই জায়গাটায় একটু তাড়াহুড়া করছো…।
কিছুক্ষণ স্বাভাবিকমুখে আমার কথা শোনে। তারপর রাগীরাগী হয়ে যায়। আমাকে বলে– থাক তোমার আর বলা লাগবে না। আমি তো দেখলাম তুমি লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ছিলে। তোমার মন ছিল না পড়ার মধ্যে।
আমি ওর হাত ধরে বলি– রাগ করছো কেন? ও আরো রেগে যায়। উঠে চলে যায় আমার সামনে থেকে। রাতে ভাত খায় না ঠিকমতো। আমি বকা খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাই। অনেক সকালে ও আমাকে ডেকে তোলে। বলে– আসোতো, পড়ে দেখো এখন। আমি ঠিক করেছি।
ওর লেখা পড়তে গিয়ে আমার কান্না চলে আসে। কতদিন পর আবার এক রকম ঘটনা ফিরে আসলো! বাবাও তো কিছুক্ষণ পর পর ডাকতো– শীলা বাবা, এখন পড়ে দেখতো ঠিক করেছি। যেন আমি কতবড় একজন ক্রিটিক! যেন কতকিছু যায় আসে আমার ভালো লাগায়, আর না লাগায়!”
আসলে লেখকের লেখা ভালো লাগে নি বললে খুব মন খারাপ হয়। শুধু লেখক নয়, সমস্ত সৃষ্টিশীল মানুষরাই তাদের সৃষ্টির প্রশংসা চায়, নিন্দা নয়। এরা খুবই সেনসেটিভ। এমনি হয়তো মুখে মুখে বলে ‘মন খুলে সমালোচনা করো’। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই সমালোচনা চায় না। তাই আমরা থাকি নিরাপদ অবস্থানে। বলি, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়; ইতিবাচক মন নিয়ে সমালোচনায় যাওয়া উচিত। হিংসা–বিদ্বেষ নয়, চাই ভালোবাসায় সুন্দর পথপ্রদর্শন।
পুনশ্চ : আগামী ২৫ ও ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৪। সকলের সহযোগিতায় সফল হতে পারে এই উৎসব।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।