বিএনপি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের বিপক্ষে বলে জানিয়েছেন দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এসময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, যারা অতীতে লুটপাট করেছে এবং দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদের ফিরে আসার অধিকার নেই।
তিনি গতকাল বুধবার নগরের মেহেদীবাগ নিজ বাসভবনে ‘চট্টগ্রাম বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরাম’র উদ্যোগে আয়োজিত সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন। সভায় সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি’র অবস্থানও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, এখন প্রতিদিন, সংস্কার সংস্কার। শেখ হাসিনা যেমন উন্নয়ন উন্নয়ন বলত। এরা সংস্কার সংস্কার বলছে। সংস্কার তো বহু আগে দিয়েছি আমরা। তোমরা কী সংস্কার করবা? সংস্কার করতে হবে জনগণের মতামত নিয়ে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পার্লামেন্টে সংস্কার হবে। যেটা টেকসই হবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হবে। যেটার জন্য আমরা ১৫ বছর যুদ্ধ করেছি। গুম হয়েছি, খুন হয়েছি, জেল খেটেছি। ৬০ লাখ বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। পালিয়ে বেড়িয়েছে, চাকরি হারিয়েছে, ধানক্ষেতে বেড়িবাঁধে থেকেছে।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যে ৩১ দফা, সেখানে সবকিছু আছে, কিছু বাকি নেই। উনারা কী সংস্কার করবেন আমি জানি না। আমরা আমাদের ৩১ দফা পরিপূর্ণভাবে আগামী দিনে বাস্তবায়ন করব। বিএনপি একা না, প্রায় ৫০টার উপরে দল মিলে ছয় মাস ধরে আলোচনা করে, বির্তক করেছি, তারপর এটা করেছি। এটা এমনিই আসেনি। এটা শেখ হাসিনা পলায়নের বহু আগে আমরা করেছি। এখন যারা সংস্কারের কথা বলে তাদের কাউকে তখন আমরা দেখিনি।
বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরামের আহবায়ক এস এম সাইফুল আলমের সভাপতিত্বে ও ফোরামের পরিচালক সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী রোকন উদ্দিন মাহমুদের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক, নগর বিএনপির আহবায়ক আলহাজ্ব এরশাদ উল্লাহ, সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান ও বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরামের সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম চৌধুরী।
আমীর খসরু বলেন, আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের লিবারালাইজ ইকোনমি করব, এটা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত। অর্থনীতিকে শিথীলকরণ করে ফেলব। ব্যুরোক্রেসির রোল আমরা কমিয়ে দেব। এখানে এই যে এতগুলো স্টেপ পার হয়ে, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশ, আমরা কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করতে চাই না। বাংলাদেশটা ধ্বংস হয়ে গেছে দলীয়করণের কারণে। প্রত্যেকটি জায়গায় দলীয়করণ করতে করতে দেশ আজ এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, যখন আমি মন্ত্রী ছিলাম তখন কে কোথাকার, কোন চেম্বারের, কোন অ্যাসোসিয়শনে কে হবে, সেসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কারণ, এটা একেবারে উচিত না। আপনাদের নেতা আপনাদের নির্ধারণ করতে হবে। কে নেতৃত্ব দিবে সেটার সিদ্ধান্ত আপনাদের। সেখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমরা চাইও না।
খসরু বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতের বিশাল পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। এই পরিবর্তনের সাথে যারা নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে পারবে না, ধারণ করতে পারবে না, আগামী দিনে সে রাজনীতিবিদ হোক, আর যেই হোক তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই দেশে। মানুষের প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা, ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে গেছে। রাজনীতিও আগের মতো চলবে না। আপনাদের (ব্যবসায়ী) ট্রেড বডিও চলবে না। এগুলোর মধ্যে নতুন ধারণা আনতে হবে। এখানে সততা আনতে হবে, স্বচ্ছতা আনতে হবে। মানুষ যাতে বাইরে থেকেও দেখতে পারে, ভেতর থেকেও দেখতে পারে। এর মধ্যে ঘোলাটে করার কোনো সুযোগ নেই। তাই এটা আমাদের সকলকে ধারণ করতে হবে।
তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এ সুযোগ যদি আমরা দেশকে পরিবর্তন করার জন্য এবার ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে আমরা সকলে ডুবে যাব। রাজনীতিবিদরা ডুববে, দেশের জনগণ ডুববে, ব্যবসায়ীরা ডুববে, সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনও কাজ করতে পারবে না। তাই এ সুযোগটা নিতে হলে সকলের মধ্যে সততা, স্বচ্ছতা, নতুন ভাবনা এবং নতুন চিন্তায় আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।
আমীর খসরু বলেন, দেশটা যেভাবে দলীয়করণ এবং লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সিএন্ডএফ এসোসিয়েশন কিন্তু তার বাইরের কেউ না। শুধু যে চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এসোসিয়েশন দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে তা নয়, দেশে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্ত করে সকলের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেওয়া। দল হিসেবে এ দায়িত্বটা পালন করছি। কে নেতৃত্বে যাবে, কোন দল যাবে, এসবের মধ্যে আমরা (বিএনপি) নেই। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন, আমরা আপনাদের সহযোগিতা করবো যাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারি।
খসরু বলেন, আপনারা (ব্যবসায়ী) নেতৃত্ব যদি ভালো আনতে না পারেন, এতে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের তো হবেই, অর্থনীতিরও হবে। তবে সবচেয়ে বেশি আপনাদের প্রতিষ্ঠান ক্ষতি হবে। আপনারা যারা মেম্বার আছেন, তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এতো গভীরে চলে যায়, তখন আমরা দেশের স্বার্থ দেখি না। মানে যে কোনো ভাবে আমাকে প্রফিট করতে হবে।
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দদের তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে হলে দোসরদের জায়গা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি দোসরদের জায়গা দেন হয় তাহলে নিজেদেরই ক্ষতি হবে। তাই আপনাদের নিজেদের অবস্থান নিতে হবে। বাইরে থেকে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না। দোসররা যাতে ফিরে না আসে। যারা লুটপাট করেছে, দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দেশের রাজনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই দোসররা যদি আবার আপনাদের এখানে ফিরে আসে তাহলে সেখানে তো আপনারা নিজেরাই আত্মহত্যা করবেন। এরজন্য আপনাদের যে অবস্থান নেওয়া দরকার, তা আপনাদের (ব্যবসায়ী) নিতে হবে। বাকিরা আপনাদের সহযোগিতা করতে পারবে, কিন্তু আপনাদের কাজ আর কেউ করতে পারবে না। এজন্য শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এখানে মাঝামাঝি কোনো অবস্থান নেই। মাঝামাঝি গেলে আপনাদের কোনো লাভ হবে না। দোসরদের বিরুদ্ধে যারা শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তারা সফল হয়েছে। আর যারা নিতে পারে নাই, চেষ্টা করেছে, আবার ভাবছে সম্পর্কের কথা এখানে এসবের কিন্তু কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, আপন ভাই হলেও দোসরদের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। আমরা আত্মীয়স্বজন আছে যারা দোসরদের সঙ্গে ছিল, তাদের আমি বাসায়ও প্রবেশ করতে দিই না। যারা এত বছর লুটপাট করেছে, এদের ফিরে আসার কোনো অধিকার নেই। আর ফিরে আসার দরকারও নেই, এদের তো হাজার হাজার কোটি টাকা হয়ে গেছে। তাদের আর ব্যবসা করার দরকার নেই। এদের এখন জেলে দেওয়া দরকার শুধু। তাদের যারা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, তারা কেউ নিয়মের মাধ্যমে হয়নি। অনিয়মের মাধ্যমেই হয়েছে, তাই এদের জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। নির্বাচন করা তো দূরের কথা, তাদের তো দেশের মানুষের সামনে, আইনের সামনে জবাবদিহিতা করতে হবে। প্রথমে জবাবদিহি তারপর নির্বাচনের ব্যাপার। সেটা অনেক পরের কথা।
তিনি বলেন, আমি শুনি মাঝে মাঝে শেখ হাসিনা যেরকম বাইরে থেকে তার লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে, নির্দেশ দেয়। আমি শুনি, বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনেরও যারা পলাতক, তারাও নাকি নির্দেশ দেয়। যারা নির্দেশ নিচ্ছে তাদেরকে সামনে আনেন, চিহ্নিত করেন, পুলিশে রিপোর্ট করেন।
এস এম ফজলুল হক বলেন, বাংলাদেশের ট্রেড বডি ও এসোসিয়েশনগুলোকে বাদ দিলে কোনো অর্থনীতিই হয় না। অর্থনীতি ছাড়া দেশ চলতে পারে না।
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী শওকত আলী, আবু ছালেহ, এড. ওমর ফারুক, আবদুল্লাহ আল মিলন, ওয়াহিদ মুরাদ, নুরুল হক, নুরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, আলী আহসান, আলমগীর সরকার, এনামুল হক চৌধুরী, এ এস এম ইসমাইল খান, মোরশেদুল আলম, শাহনেওয়াজ রুমি, তাজুল ইসলাম, গোলাম নবী, মো. আলমগীর, আবু তাহের, উপস্থিাত ছিলেন ব্যবসায়ী ফোরামের জয়নাল আবেদীন জিয়া, হুমায়ুন কবির সোহেল, জামাল উদ্দিন বাবলু।