রাজসাক্ষী মামুনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ট্রাইব্যুনাল, বলছেন প্রধান কৌঁসুলি
জুলাই অভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তার সরকারের স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এ দাবি জানান প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ মামলার অপর আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল–মামুন ইতোমধ্যে নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাজুল ইসলাম বলেন, তারা মনে করেন, সাবেক আইজিপি মামুন তার জবানবন্দিতে ঘটনা সম্পর্কে সত্য প্রকাশ করেছেন। তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ট্রাইব্যুনাল। খবর বিডিনিউজের।
এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হচ্ছেন মো. আমির হোসেন। তিনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে এক সপ্তাহ সময় আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল আগামী সোমবার থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এ মামলার বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। দিনের কার্যক্রমের শুরুতে কৌঁসুলি মো. মিজানুল ইসলাম এ মামলায় ৩ নম্বর অভিযোগের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। এ অভিযোগ ছিল রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার বিষয়ে। তার বক্তব্যে আবু সাইদকে গুলি করা কনস্টেবল আমির আলী ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্রের নাম আসে। এ সময় ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদকে গুলি করার সেই ভিডিওটি দেখানো হয়, যা গত বছরের ১৬ জুলাই এনটিভিতে লাইভ প্রচার করা হয়েছিল।
মিজানুল ইসলাম বলেন, আবু সাঈদকে হত্যা করার সময় হাতে লাঠি ছাড়া কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ছিল না। তার লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বারবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রহণ না করে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে বলা হয়েছিল যেন গুলিতে মৃত্যুর কথা না লিখে মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যুর কথা লেখা হয়। কিন্তু ওই চিকিৎসক তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে এক পর্যায়ে বিদেশে চলে যেতে প্রলুব্ধ করেন সরকারি দলের লোকজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই চিকিৎসক লেখেন, ‘মাথায় আঘাতে মৃত্যু হয়েছে’। তবে আদালতকে অবস্থানগত সাক্ষ্য বিবেচনা করার কথা বলেন।
মিজানুল ইসলামের বক্তব্য শেষ হলে প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ৪(১) এবং ৪(৩) পড়ে শোনান। একই সঙ্গে ‘রোম স্ট্যাটিউট’–এর অনুচ্ছেদ ২৮ তুলে ধরেন। এই আইনে শেখ হাসিনার ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ কীভাবে ‘প্রমাণিত’ হয়েছে তিনি তা উপস্থাপন করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যাটাক’ কিংবা ‘সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাক’ যেকোনো একটি প্রমাণিত হলেই মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়। এছাড়া নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জ্ঞাত থাকার (নলেজ অব কমিটিং অ্যাটাক) বিষয়ে তিনি বলেন, তাপসের সঙ্গে, ইনুর সঙ্গে এবং মাকসুদ কামালের সঙ্গে কথপোকথন থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়েছে সব হামলার ব্যাপারে তিনি (শেখ হাসিনা) সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত (ফুললি অ্যাওয়ার) ছিলেন। তিনি নিজে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে প্রধান কৌঁসুলি বলেন, তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ কমান্ড তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। তার বাসায় কোর কমিটির বৈঠক হত। তিনি আইজপিকে নির্দেশ দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে এক পুলিশ কর্মকর্তার ভিডিও দেখেছেন তিনি, যেখান ওই কর্মকর্তা বলেন– ‘স্যার গুলি করি একটা, একজন চলে যায়, বাকিরা যায় না’। তাজুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। তিনি যেহেতু নির্দেশ দিয়েছিলেন তাই তিনি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থার চেষ্টাও করেননি। তাই তিনি বলতে পারেন না যে তিনি জানতেন না। এরপর প্রধান কৌঁসুলি জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ ও ৫০ ধারা এবং রোম স্ট্যাটিউটের ২৫(৩) অনুচ্ছেদে তুলে ধরন। জেনেভা কভেশনের ৮৭ ধারায় আদেশকারীর দায়িত্বের কথা বলা হয় এবং তা তিনি পড়ে শোনান।
তাজুল ইসলাম কমান্ড রেসপনসিবিলিটির ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের কয়েকটি রায় ও সিদ্ধান্ত পড়ে শোনান। জেনেভা প্রটোকল–১ তুলে ধরেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি জেনারেল তোমোয়ুকি ইয়ামাশিতার যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ তিনটি মামলার অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালে। তিনি বলেন, ওইসব মামলায় যেভাবে ওয়াইডস্প্রেড এবং সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাক প্রমাণ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে এখানে প্রমাণিত হয়েছে। নিরস্ত্র জনগণের ওপর ওয়াইডস্প্রেড এবং সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাক হয়েছে। এন্টায়ার পপুলেশন অব জিওগ্রাফিক্যাল এনটিটি–এর ওপর অ্যাটক হয়েছে, লার্জ স্ক্যাল অ্যাটাক। তাজুল বলেন, এত ব্যাপক হামলা, মৃত্যু, আহত। ১৪০০ জন নিহত এবং ২৫০০০ আহত হয়েছেন। একজনের জন্য একবার মৃত্যুদণ্ড হলে তার ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া দরকার।
নৃশংসতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একজন লোক আহত হয়ে পড়ে আছে, তাকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। অথচ সে কোনো ধরনের হুমকি ছিল না। নিহত ব্যক্তিকে তার স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়নি, লাশ দাফন করতে দেওয়া হয়নি। তাজুল যুক্তিতর্কে বলেন, রাষ্ট্রের পুরো ফোর্সকে তিনি (শেখ হাসিনা) ব্যবহার করেছেন। বিজিবি, পুলিশ, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা, শুধু সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেননি।