হাসিনাসহ তিনজনের বিচার শুরু

মানবতারিরোধী অপরাধ

| শুক্রবার , ১১ জুলাই, ২০২৫ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

জুলাই অভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনিই কারাগারে আটক আছেন, বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল১ গতকাল বৃহস্পতিবার হাসিনা ও কামালের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেয়। সেই সঙ্গে প্রসিকিউশনের প্রারম্ভিক বিবৃতির (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) ৩ আগস্ট এবং মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ৪ আগস্ট দিন রেখেছে আদালত। আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট ৫ অভিযোগ আনা হয়েছে তিন আসামির বিরুদ্ধে। খবর বিডিনিউজের।

এর পক্ষে আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া সংক্রান্ত শেখ হাসিনার অডিও টেপ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হল। আর তা শুরু হল সেই আদালতে, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য।

৫ অভিযোগ : ট্রাইব্যুনালে এ মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে। গত ১ জুন প্রসিকিউশনের দেওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ এনে গত ১২ মে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেখানে শেখ হাসিনাকে জুলাইআগস্টের নৃশংসতার মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

অভিযোগ: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদেরকে রাজাকার এবং রাজাকারের বাচ্চা বলে তাদেরকে নির্মূল করার জন্য যে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তারই ধারবাহিকতায় গোটা বাংলাদেশ জুড়ে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর যে আক্রমণ শুরু হয় তাতে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়, প্রায় ২৫ হাজার ছাত্রজনতাকে আহত করা হয়। অনেকে অন্ধত্ব বরণ করেছেন, অনেকে অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন। তার উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সারাদেশ ব্যাপী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আইজিপি চৌধুরী আল মামুনের নেতৃত্বে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। সেই অভিযোগে প্রথম অভিযোগটি গঠন করা হয়।

অভিযোগ: গণভবন থেকে শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য মাকসুদ কামালের সাথে কথোপকথন এবং ১৮ তারিখে তার ভাতিজা শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথে আরেকটি টেলিফোন কনভারসেশনে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, আন্দোলনরত ছাত্রজনতাকে হত্যা করার জন্য। মারণাস্ত্র ব্যবহার করে তাদের হত্যা বা নির্মূল করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন হেলিকপ্টার এবং ড্রোন ব্যবহার করে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করার জন্য। সেই নির্দেশের কথা তিনি দুটি টেলিফোন কনভারসেশনে উল্লেখ করেছেন। আদেরকে আশ্বস্ত করেছেন, আমি নির্দেশ দিয়েছি, সুতরাং এ বিক্ষোভ দমন হয়ে যাবে, নির্মূল হয়ে যাবে। তার এ আদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের মাধ্যমে সমস্ত বাহিনীগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের কাছে কনভে করা হয়েছে, ছাত্রলীগযুবলীগের কাছে কনভে করা হয়েছে। এবং সেই নির্দেশের আলোকে দেশব্যাপী দেড় হাজার ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগ: ১৬ জুলাই রংপুরে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে পুলিশ পরপর অনেকগুলো গুলি করে হত্যা করে। এটি হয়েছিল শেখ হাসিনার নির্দেশের প্রেক্ষিতে এবং এ নির্দেশটি প্রকাশ হয়েছিল তার টেলিফোন কনভারসেশন থেকে। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে বলেছিলেন রাজাকারের বাচ্চা, তারই ধারাবাহিকতায় রংপুরে আবু সাইদকে হত্যা করা হয়। হত্যা করার পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজে। সেখানে হত্যার প্রকৃত কারণ গোপন করার জন্য পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ হত্যা, হত্যাচেষ্ট, ষড়যন্ত্র, নির্দেশ এর মাধ্যমে এই আসামিরা তাদের সুপিরিয়র স্ট্যাটাস ব্যবহার করে রংপুরের পুলিশ প্রশাসন এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে সেখানে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন সে দায়ে তৃতীয় অভিযোগটি গঠন করা হয়েছে।

অভিযোগ ৪ : আগস্টের ৫ তারিখ যখন সারা বাংলাদেশ থেকে ছাত্রজনতাকে ঢাকা আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল, সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যখন ছাত্রজনতা আসছিল সে সময় রাজধানীর চানখার পুল এলাকায় বেলা ১০টা থেকে আড়াইটার মধ্যে এ তিন আসামির নির্দেশে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারের মাধ্যমে ও অন্যান্য পুলিশ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। তার মধ্যে শহীদ শহরিয়ার খান আনাজ, জুনাইদসহ আরও চারজন রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি এবং তাদের অধীনস্তদের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়ে চতুর্থ অভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযোগ: তাদের নির্দেশে সাভারের এমপিসহ অধীনস্তদের সাহায্যে সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে ৫ আগস্ট বিকালবেলা লেথাল উইপন ব্যবহার করে ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ গঠন করা হয়। একটি গলির মধ্যে ঠান্ডা মাথায় সাব মেশিনগান এবং চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।ওই ছয় জনকে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পোড়ানোর সময় একজন নড়াচড়া করছিল, তাকে উদ্ধার না করে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি মামুন
পরবর্তী নিবন্ধকোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে মেয়র ও প্রধান নির্বাহীকে লিগ্যাল নোটিশ