ছয় মাসের শিশু রাইসা আলমকে কোলে নিয়ে নেবুলাইজ (শ্বাসযন্ত্রের ওষুধ প্রয়োগ) করছেন মা মিনু আকতার। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি করেন মেয়েকে। ডাক্তার বুকের এক্সরে করে দেখেন–নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন রাইসা। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে, শ্বাসটান থাকায় মায়ের দুধও ঠিকমত পান করতে পারছে না।
শুধু শিশু রাইসা নয়, শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য ওয়ার্ডে বাড়ছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এদের বেশিরভাগের বয়স ৫ বছরের নিচে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল ১২ নভেম্বর পালিত হবে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। এর এক তৃতীয়াংশ আবার নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী। চাপ বাড়ার কারণে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম মা–শিশু ও জেনারেল হাসপাতালেও বেড়েছে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত টিকাদান, স্বাস্থ্যকর জীবন এবং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা এই তিনটি বিষয় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারে। মানুষের মধ্যে নিউমোনিয়া সম্পর্কে অসেচতনতা রয়েছে। রোগী ও অভিভাবকের অজ্ঞতার কারণে অনেকে সময় মতো হাসপাতালে যান না। বিশেষ করে নগরায়ণের ফলে দূষণ এবং প্রান্তিক পর্যায়ে রোগীদের অসচেতনায় নিউমোনিয়া বাড়ছে।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সেঁজুতি সরকার বলেন, নিউমোনিয়া মূলত ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। রোগের শুরুতে কাশি হয়, যা সাধারণত ২–৪ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে কিছুক্ষেত্রে শিশুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে–শিশুর বুক বেশি দেবে গেলে, ঘন ঘন শ্বাস নিলে, মায়ের দুধ পানে সমস্যা ও খিঁচুনি হলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
চমেক হাসপাতাল শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. সুপর্না দাশ দৈনিক আজাদীকে বলেন, শীত মৌসুম শুরুর আগে নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। চমেক হাসপাতালে সব সময় রোগীর চাপ থাকে। সম্প্রতি নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। সাধারণত যেসব শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের নিউমোনিয়া বেশি হয়। এছাড়া প্রি–ম্যাচিউরড (সময়ের আগে জন্ম নেয়া) শিশুদেরও নিউমোনিয়া বেশি হয়। ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিজনিত কারণেও নিউমোনিয়া হয়। এখন নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে গর্ভকালীর মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া স্বল্প বিরতিতে সন্তান জন্ম দিলেও সেই সন্তানের ওজন কম হতে পারে। মা–বাবা কেউ ধুমপায়ী হলে সন্তানের নিউমোনিয়া হতে পারে। পর্যাপ্ত আলো বাতাস ছাড়া স্যাতস্যাতে পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশু নিউমোনিয়ার ঝঁকিুতে থাকে। শিশু জন্মের পর থেকে ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বুকের দুধে নিউমোনিয়া প্রতিরোধক ভিটামিন এ থাকে। ফিডারে কোনো কিছু খাওয়ানো যাবে না। নিয়মিত হাঁত ধোঁয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ঘরে বড় কারো সর্দি কাশি হলে শিশুদের তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া শিশুকে সরকার নির্ধারিত সব টিকা দিতে হবে। যেসব শিশুর ঘন ঘন সর্দি কাশি হয় তাদের বেসরকারি ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা দিতে হবে। এসব নিয়ম মেনে চললে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।